‘স্বাদে-গন্ধে’ ভেদ নেই পদ্ম-ঘাসফুলে

‘স্বাদে-গন্ধে’ ভেদ নেই পদ্ম-ঘাসফুলে

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


গৌতম সরকার

রাজনীতি বড় কঠিন ঠাঁই হে! টের পাচ্ছেন কঙ্গনা রানাওয়াত। যিনি মুখ খুললেই আলটপকা মন্তব্য। সদ্য নিজের নির্বাচনি কেন্দ্রে হড়পা, ধসের বিপর্যয় দেখতে গিয়েও তাই হল। কুলু-মানালির দুর্গতরা খানিক বিক্ষোভ, খানিক অনুযোগ করেছিলেন। তাঁদের দুর্দশা শুনতে শুনতে কঙ্গনা বেমক্কা বলে বসলেন, ‘আমার কষ্টটাও ভেবে দেখুন আপনারা।’ কী কষ্ট তাঁর? ওই এলাকায় তাঁর রেস্তোরাঁয় নাকি এই পরিস্থিতিতে একদিনে মাত্র ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে।

অথচ রেস্তোরাঁর কর্মীদের তিনি নাকি মাস গেলে ১৫ লক্ষ টাকা মাইনে দেন। ভাবটা এমন, রাজনীতি করতে এসে এত খেসারত দেওয়া যায় নাকি! রাজনীতি করতে এসে তাঁর রোজগার কম হচ্ছে বলে কয়েক মাস আগে আক্ষেপ করেছিলেন। এখন হিমাচলপ্রদেশে বন্যাদুর্গতদের দুর্দশা ছাপিয়ে তাঁর কষ্টটাই বড় হয়ে উঠল। কথায় আছে না- লজ্জা, ঘেন্না, ভয়- তিন থাকতে নয়। কথাটা রাজনীতিতে খুব খাটে।

শিলিগুড়িতে বিজেপির জেলা দপ্তরে ধুন্ধুমার ঘটে গেল দিনকয়েক আগে। দলের জেলা সভাপতি অরুণ মণ্ডলের সঙ্গে ঝগড়ায় এমন হল যে, সহ সভাপতি দেবযানী সেনগুপ্ত অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অপমানে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। কী আশ্চর্য! দলের অন্যতম জাতীয় মুখপাত্র রাজু বিস্ট অবলীলায় বলে দিলেন ‘এরকম ঘটনা ঘটে থাকে।’ যেমন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক কিছুকে ছোট ঘটনা বলে উড়িয়ে দেন।

লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের নিরিখে শিলিগুড়ি মহকুমায় পদ্মফুলের একচ্ছত্র প্রভাব। তিনটি বিধানসভা আসনের তিনটিই বিজেপির। এলাকার সাংসদও সেই দলের। অথচ গোষ্ঠীকোন্দলে শিলিগুড়ির বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলে কোনও ফারাক নেই। কিছুদিন আগে শিলিগুড়ির অদূরে বিধাননগরের একদল নেতা-কর্মী জেলা দপ্তরে বিক্ষোভ দেখিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর বিক্ষুব্ধরা একটি হোটেলে আলাদা বৈঠক করে বিধানসভাভিত্তিক পৃথক কমিটি করে ফেলবেন ঠিক করেছেন।

এ যেন দলের সাংগঠনিক কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ। এতটা সাহস তৃণমূলে কিন্তু কারও নেই। কোচবিহারে তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা লগ্নের সেনাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ও প্রাক্তন সাংসদ পার্থপ্রতিম রায় আজকাল দলের জেলা কমিটির সভা বা কর্মসূচি এড়িয়ে চলেন। তাই বলে সমান্তরাল সংগঠন বা কমিটি গড়ার দুঃসাহস তাঁদের নেই। দক্ষিণ দিনাজপুরে জেলা সভাপতি সুভাষ ভাওয়ালের বিড়ম্বনা বেড়েছে তাঁর সুপারিশমতো জেলা কমিটির প্যানেলে রাজ্য নেতৃত্ব সায় না দেওয়ায়।

জেলা কমিটি ঘোষণার জন্য সাংবাদিক বৈঠক ডেকে শেষপর্যন্ত তাঁকেই সাময়িক ‘আত্মগোপন’ করতে হয়েছিল। তিনি দক্ষিণ দিনাজপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী বিপ্লব মিত্রের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু জেলায় যতই প্রতাপ থাক, রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মতো ঘাড়ে মাথা না আছে সুভাষের, না আছে বিপ্লবের। শুধু গোষ্ঠীকোন্দল নয়, কুকথা আর আলটপকা মন্তব্যতেও তৃণমূলের সঙ্গে জোর টক্কর এখন বিজেপির।

অটলবিহারী বাজপেয়ী একসময় গর্ব করে নিজের দলকে বলতেন, ‘পার্টি উইথ ডিফারেন্স।’ সেই ‘ডিফারেন্স’টা এখন ঘেঁটে ঘ হয়ে গিয়েছে। শিলিগুড়ির বিধায়ক শংকর ঘোষ সিপিএমে দাপুটে যুব নেতা ছিলেন। বিজেপিতে যোগ দিয়ে তিনি শুধু বিধায়ক নন, বিধানসভায় পরিষদীয় দলের মুখ্যসচেতকের দায়িত্বও পেয়েছেন। কিন্তু তিনি যে স্বস্তিতে নেই, তার প্রমাণ সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পোস্ট।

যেখানে আক্ষেপ করেছেন, লড়াইটা তাঁর ‘একক’। দলের মধ্যে এই নিঃসঙ্গতার কারণ যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তা বুঝতে রাজনীতিতে পণ্ডিত হওয়ার দরকার হয় না। ভাগ্যিস, মালদার বাইরে তৃণমূলের জেলা সভাপতি আব্দুর রহিম বক্সীকে বড় একটা কেউ চেনেন না। নাহলে অনুব্রত মণ্ডল বা উদয়ন গুহদের মতো তিনি কুকথার ‘সেলেব্রিটি’ হয়ে যেতেন। কখনও তিনি বিজেপি বিধায়কের গলায় অ্যাসিড ঢেলে দেবেন হুংকার দিচ্ছেন। কখনও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেই ‘মানুষখেকো’ বলে গাল পাড়ছেন।

তৃণমূলের এই হুমকি মাস্টারদের ‘অনুপ্রেরণা’র সংক্রমণে ‘এক সে বড়কর এক’ আগুন ঝরাচ্ছেন বিজেপির নেতারা। এব্যাপারে একসময় কুখ্যাতি ছিল দিলীপ ঘোষের। তৃণমূল থেকে হুমকির পারদর্শিতা নিয়ে বিজেপিতে গিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। অধ্যাপকের ভদ্র আলখাল্লাটা ছুড়ে ফেলে সুকান্ত মজুমদার এখন আস্ফালনের ‘সুপারহিট হিরো’। ২০২৬-এ বিধানসভা ভোটে জিতে রাজ্যের মসনদে বসেই নাকি তিনি তৃণমূলের ‘বেয়াদব’ নেতা-কর্মীদের ‘প্যাকেট করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে’ দেবেন।

প্যাকেট করে ফ্রিজে! ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। ছত্রে ছত্রে হিংসার আগমনী। ‘পার্টি উইথ ডিফারেন্স’কে কোনও বিষয়েই আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। তৃণমূলের উদয়ন গুহর হাঁটু ভেঙে দেওয়া, ভোটে জিততে গুন্ডামি করার সুরে মিলে যায় সুকান্তর ‘প্যাকেট করে’ দেওয়ার আস্ফালন। দুজনের কেউই কিন্তু এলিতেলি নেতা নন। একজন রাজ্যের, অন্যজন কেন্দ্রের মন্ত্রী। তাঁদের কাছ থেকে দুই দলের কর্মী-সমর্থকরা তো হুমকি সংস্কৃতিই শিখছেন।

গোষ্ঠীকোন্দলে তৃণমূলের দেখানো পথে বিজেপির যেন গুরুমারা বিদ্যা শেখা হয়ে গিয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনায় ঠাকুরনগরের মতুয়াগড় সেই বিদ্যায় এত চৌখস হয়ে উঠেছে যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর ও তাঁর ভাই সুব্রতর কাজিয়ায় ঘরের অনেক ‘গোপন’ কথা বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। পাঠক, একবার ভেবে দেখুন তো, নবীন প্রজন্মের কেউ যদি দেশের সেবা করার মহান ব্রত নিয়ে রাজনীতিতে নিজেকে জড়াতে চান, তাহলে তাঁর সামনে আদর্শ কে বা কারা? কাকে বা কাদের দেখে রাজনীতিতে আসবে পরবর্তী প্রজন্ম?

কুকথা, আস্ফালন আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যেখানে রাজনীতির সমার্থক হয়ে ওঠে, সেখানে এসব প্রশ্ন অর্থহীন বোধ হয়। মতাদর্শগত দেউলিয়াপনার এই অকূলপাথার তাই দেশসেবার বদলে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার আখড়া হয়ে উঠেছে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *