ওঁদের কি শহিদ বলা যাবে? ওঁদের, যাঁরা অন্যের হয়ে অন্য দেশে গিয়ে অচেনা শত্রুদের হাতে মারা গিয়েছেন? এমনিতে আমরা শহিদ বলতে বুঝি নিজের দেশের স্বাধীনতা আনতে যাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। কিংবা যাঁরা দেশের সীমান্তে দাঁড়িয়ে সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে গিয়ে যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদের।
আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরও শহিদ রয়েছেন। একসময় কলকাতার ফুটপাথে কাতারে কাতারে শহিদ বেদি নজরে পড়ত। কেউ নকশাল, সিপিএম করতেন, কেউ বা কংগ্রেসি। সত্তর দশকে গুলি-বোমায় তাঁরা গত হয়েছেন। আবার ধরুন, বাস্তারের জঙ্গলে কিংবা জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের হাতে যেসব আধাসেনা প্রাণ দিচ্ছেন, তাঁরা শহিদ। তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টি হয়। আবার আধাসেনার হাতে যেসব মাওবাদী মারা যাচ্ছেন শহিদ তাঁরাও, তাঁদের কমরেডদের কাছে। বলতে গেলে এ দেশ শহিদপ্রসবা।
এত ভিন্ন ক্যাটিগোরির শহিদদের লাইনে কোথায় দাঁড় করানো যাবে বিনিল বাবুকে? কেরলের ত্রিচুর জেলার কুট্টানেল্লুরের ৩২ বছরের তরুণ বিনিল। গত সপ্তাহে তাঁর মৃত্যুর খবর এসেছে। কেরল থেকে অনেক দূরের এক যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন হামলায় মারা গিয়েছেন বিনিল। না, নিজের দেশের জন্য নয়, অন্য দেশের হয়ে লড়ছিলেন তিনি। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর একজন ভাড়াটে সৈন্য হয়ে। যে দুই দেশ ভারত থেকে বহু বহু দূরে। মানচিত্র ঘেঁটে খুঁজে বের করতে হয়। কেরলের আরেক তরুণ, ২৭ বছরের জৈন কুরিয়ান মারাত্মক জখম হয়ে এখন মস্কোর হাসপাতালে ভর্তি।
কেউ বেকার, কেউ বা আরও একটু ভালো থাকতে পা দিয়েছিলেন অজানা পথে। দালালদের হাত ধরে। তাঁদের বলা হয়েছিল, ভালো চাকরি আর রুশ নাগরিকত্বের কথা। সঙ্গে আরও কত ভালো ভালো স্বপ্নমাখা টোপের কথা। তাঁরাও উঠে পড়েছিলেন মস্কোর প্লেনে। তাঁদের বলা হয়েছিল বিভিন্ন কারখানায়, স্টোরে কাজের কথা। বদলে তাঁদের ঘাড় ধরে পাঠানো হয়েছিল সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে। কাউকে ট্রেঞ্চ কাটতে হয়েছে, কাউকে মাইন আর গোলাগুলির মধ্যেই রসদ সরবরাহের কাজ করতে হয়েছে। পরে সামান্য ট্রেনিং দিয়ে তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে গোলাগুলির মুখে। এর আগে প্রাণ দিতে হয়েছিল কেরলেরই আরেকজনকে, নাম সন্দীপ। একইভাবে।
ঠিক কতজন ভারতীয়কে ভিনদেশি লড়াই লড়তে পাঠানো হয়েছে, তা জানে না কেন্দ্রীয় সরকার। বিদেশমন্ত্রক জানাচ্ছে, কম করেও অন্তত ১২৬ জনের হদিস তারা পেয়েছে। তাঁরা রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনে লড়তে গিয়েছেন। তবে সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। তাঁদের ঠেকানোর চেষ্টায় ফল হচ্ছে না। যুদ্ধে মারা গিয়েছেন ১২ জন। দেশে ফিরেছেন ৯৬ জন। আর স্রেফ হারিয়ে গিয়েছেন ১৬ জন। সরকার জানাচ্ছে, তাঁদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রাশিয়ার কাছেও তাঁদের কোনও হদিস নেই। তাঁদের কারও বাড়ি পঞ্জাব, কারও হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, কারও বা কাশ্মীরে।
কালিম্পংয়ের হিমালিগাঁওয়ের উরগেন তামাং ওই দালালদের হাত ধরে আরও কয়েকজনের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন রাশিয়ায়। গত জানুয়ারিতে। ৪৭ বছরের উরগেন এক্স আর্মি হাবিলদার। অবসরের পর সাত বছর আগে তিনি নিরাপত্তারক্ষীর কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন গুজরাটে। তাঁকে রক্ষীর কাজ দেওয়া হবে বলে সেখান থেকে দালালরা পাঠিয়ে দেয় মস্কো। বিমান থেকে নামতেই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেনাছাউনিতে। সেখানে মাত্র ১২ দিনের ট্রেনিং পেয়েছেন তিনি। তারপর সিধে লড়াইয়ের ময়দানে। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন উরগেন। ফিরে জানিয়েছেন তাঁর ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা। তাঁর ইউনিটে ১৫ জন ভিনদেশির মধ্যে মারা গিয়েছেন ১৩ জনই। এরকমই আরও কতজন যে আছেন তালিকায়।
এখন, এই অমৃতকালে যখন কর্মসংস্থানের ঢক্কানিনাদে কান পাতা দায় তখন স্রেফ রুটিরুজির জন্য বিদেশ বিভুঁইয়ে গিয়ে অন্য দেশের হয়ে যুদ্ধ করে বেঘোরে প্রাণ দেওয়াটা কেমন অবাক করে না? দলে দলে ইজরায়েলে যাওয়ার খবরও আসছে। সেখানে শুধু যুদ্ধ নয়, আরও নানারকম কাজে যোগ দিতে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়েছে হরিয়ানা, পঞ্জাবে। জানা যাচ্ছে, দশ হাজার নির্মাণকর্মী আর পাঁচ হাজার সেবাকর্মী তাদের দেশে নিতে চাইছে ইজরায়েল। প্যালেস্তাইনের সঙ্গে যুদ্ধ লাগার পর ১ লক্ষ প্যালিিস্তনীয়কে বের করে দিয়েছে তারা। তাদের জায়গায় ভারত থেকে কর্মী নিয়ে যেতে চাইছে ইজরায়েল। এ দেশ না হোক, ওদেশে তো কাজ পাবে পনেরো হাজার বেকার। মন্দ কী!