স্কুলে ফাঁকিবাজি! মেধায় কামড় বসাচ্ছে এআই 

স্কুলে ফাঁকিবাজি! মেধায় কামড় বসাচ্ছে এআই 

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


দীপ সাহা

ক্লাসরুমে এক্কেবারে পিন পড়ার মতো নীরবতা। টেবিলে পাঁচখানা হোমওয়ার্কের খাতা পাশাপাশি রেখে গম্ভীর মুখে কিছু একটা মেলানোর চেষ্টা করছেন শিক্ষিকা নীলাক্ষি সোম। ব্যাগ থেকে মুঠোফোনটা বের করে খাতাগুলোর ছবি তুলছেন এক-এক করে। ক্লাস এইটের ছাত্ররা তখন বুঝে গিয়েছে, আজ আর উপায় নেই। ধরে ফেলেছেন দিদিমণি।

এক-এক করে ওই পাঁচজনকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে ডাকলেন নীলাক্ষি। প্রথমে প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘এই লেখাটা তুমি নিজে লিখেছ তো?’ ঘাড় কাত করে ‘হ্যাঁ’ জবাব দিল একজন। দিদিমণি তাকে বললেন, ‘যাও তিন নম্বর প্যারাগ্রাফটায় যেটা লিখেছ, সেটা ক্লাসের বাকিদের বোঝাও।’ ছাত্রটির মুখ তখন কাচুমাচু। কিছুক্ষণ চক নিয়ে আঁকিবুকির পর যখন বুঝতে পারল নিস্তার নেই, তখন স্বীকার করে নিল, লেখাটি সে নিজে লেখেনি। লিখেছে এআই অর্থাৎ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। শুধু ওই ছাত্রটি নয়, বাকি চারজনও একই পথে হেঁটেছে।

নীলাক্ষি শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পড়ান। সেদিনের পর থেকে ভীষণ সতর্ক তিনি। বাচ্চাদের হোমটাস্ক দিলেই তাঁর ভয় থাকে এখন। নীলাক্ষি বলছেন, ‘সন্দেহটা এমনি এমনি হয়নি সেদিন। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও তাঁর প্রভাব নিয়ে প্রবন্ধ লিখে আনতে বলেছিলাম। পাঁচটা খাতায় লেখা মোটামুটি একরকম। হতে পারে, সবাই একসঙ্গে বসে লিখেছে। আজকাল হয় সেটা। কিন্তু খটকা লাগল কয়েকটা কঠিন শব্দ ও বাক্য নিয়ে। অমন কঠিন শব্দ ওদের জানার কথাই নয়। তখনই বুঝেছিলাম, এ নির্ঘাত এআই-এর অপব্যবহার।’

শুধু শিলিগুড়ির ওই স্কুল নয়, উত্তরবঙ্গের একাধিক ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের পড়ুয়াদের এআই নির্ভরতা বাড়ছে বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন শিক্ষকদের একটা বড় অংশ। হোমটাস্ক, অঙ্ক কষা এমনকি কবিতা লেখার জন্যও এআই-এর দ্বারস্থ হচ্ছে পড়ুয়ারা।

এআই এখন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। হেন কোনও বিষয় নেই, এআই-এর জানা নেই। নেটের গতি দুর্দান্ত থাকলে মিলি সেকেন্ডের মধ্যে যে কোনও বিষয় তুলে ধরছে চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, মেটা-র মতো এআই টুলগুলি। অন্তর্জাল থেকে সমস্ত তথ্য একত্রিত করে নিমেষে সাজিয়ে পরিবেশন করছে গ্রাহকদের। আর এখানেই ভয় পাচ্ছে শিক্ষক মহলের একাংশ। কারণ ইন্টারনেটে সহজলভ্য সব তথ্যই যে ঠিক, এমনটা নয়। ফলে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কিছু শিখতে বা লিখতে গেলে পড়ুয়ারা আদতে ভুলপথে পরিচালিত হবে।

যেমনটা হয়েছিল জলপাইগুড়ির একটি নামী স্কুলে। সেক্ষেত্রে অবশ্য অভিভাবকের গাফিলতি সামনে এসেছে। স্কুলটির সহকারী শিক্ষকের কথায়, ‘সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়াদের পরিবেশ বিষয়ক প্রোজেক্ট দেওয়া হয়েছিল। একজন পড়ুয়া কিছু ভুল তথ্য পেশ করেছিল। পরে সে জানায়, তার মা-ই এআই ব্যবহার করে ওই তথ্য জোগাড় করেছিল। পরে তাঁকে ডেকে স্কুলের তরফে সতর্ক করে দেওয়া হয়।’

শিলিগুড়ির একটি স্কুলে তো আবার অনলাইন পরীক্ষা বাতিল করে দিতে হয়েছিল এআই-এর অপব্যবহারের জন্য। সেই স্কুলটির এক শিক্ষিকা জানাচ্ছেন, শুধু লেখালেখির ক্ষেত্রে নয়, সামান্য চিঠি লিখতে, মেল করতেও বাচ্চারা এখন এআই ব্যবহার করছে। এই প্রবণতা ভয়ংকর।

এমনিতেই পাশ-ফেল প্রথা উঠে যাওয়ায় স্কুল শিক্ষার হাল বেহাল। তার ওপর এআই নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় ছাত্ররা শেখার আগ্রহ আরও কমিয়ে দিচ্ছে বলে মত শিক্ষকদের। তবে, সচেতনতার মধ্যে দিয়ে প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করলে তা শিক্ষার সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন মালদার রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক স্বামী তপহারানন্দজি মহারাজ। তিনি বলছেন, ‘এআই ব্যবহার করে খুব সহজেই হোম‌ওয়ার্ক করে নেওয়ার মানসিকতা অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। যে কোন‌ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম দিকে এটা হয়। তবে সময় এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এআই-এর সঠিক ব্যবহার করবে বলেই আমার ধারণা।’

সাহিত্যিক তথা শিক্ষিকা সেবন্তী ঘোষও এবিষয়ে তপহারানন্দজি মহারাজের সঙ্গে একমত। তিনি বলছেন, ‘প্রযুক্তি সবাইকে গ্রাস করে নেবে এটা হতে পারে না। প্রথম যখন কম্পিউটার এসেছিল, তখন‌ও সবাই ভেবেছিল মানুষের বুঝি আর প্রয়োজন নেই। এআই-ও ঠিক তাই। সৎভাবে ব্যবহার করলে তা আমাদের জন্য আগামীতে সহায়ক হবে।’

এআই-এর ব্যবহার করতে গিয়ে সৃজনশীলতাও হারিয়ে যাচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে। শিলিগুড়ির বাণীমন্দির রেলওয়ে স্কুলে যেমন ম্যাগাজিনের জন্য লেখা চাওয়া হয়েছিল পড়ুয়াদের কাছে। দুজন এমন কবিতা জমা দেয়, যা দেখে সন্দেহ জাগে শিক্ষকদের। জানা যায়, সেই কবিতাও নাকি এআই-এর মাধ্যমে লেখা। স্কুলটির শিক্ষক অপূর্ণময় ঘোষ বলছেন, ‘এমন প্রবণতা সবার মধ্যে যে আছে এমনটা নয়। কিন্তু কিছু ছাত্র ভয়ংকরভাবে এআই ব্যবহার করছে। এখনই তাদের সতর্ক না করতে পারলে মুশকিল।’

যে কোনও প্রযুক্তির সুফল ও কুফল দুটোই আছে। পড়ুয়ারা কোনটাকে গ্রহণ করবে আর কোনটাকে নয় সেটা তাদেরও বোঝা উচিত। এমনই মত ইংরেজবাজারের বার্লো গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দীপশ্রী মজুমদারের। তিনি বলছেন, ‘ছাত্রছাত্রীরা এআইকে ব্যবহার করে যদি সরাসরি তা নোটবুকে তুলে নেয় তবে সেক্ষেত্রে তাদের মস্তিষ্কের কোন‌ও ব্যবহার হবে না। তবে এআই থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে যদি পড়ুয়ারা নিজেদের চিন্তাভাবনা তুলে ধরে তবে সেটা বেশ কার্যকরী হবে। তবে যদি কেউ পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে গিয়ে এআইয়ের সাহায্য নিয়ে উত্তর লেখে তবে সেটা খারাপ।’

রাজ্যের বেশকিছু স্কুলে ইতিমধ্যে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এআই। সেক্ষেত্রে কীভাবে দায়িত্বশীল এবং সমালোচনামূলকভাবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করতে হয়, তা শিক্ষার্থীদের শেখানো দরকার বলে মনে করছেন কোচবিহারের রামভোলা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তপনকুমার দাস। তিনি বলছেন, ‘বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়ারা এখনও এআই বা চ্যাট জিপিটি অতটাও সড়োগড়ো নয়। তাছাড়া যে ধরনের প্রোজেক্ট তাদের দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে এধরনের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও তা ফলপ্রসূ হবে না। কারণ এসবের ভাষা আরও উন্নত। যা দেখে আমরা সহজেই বুঝে যাব এটা পড়ুয়ার মস্তিষ্কপ্রসূত ভাষা নয়। এটা ঠিক, এধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে, তাতে অদূরভবিষ্যতে প্রোজেক্ট দেওয়া নিয়েও শিক্ষা দপ্তরকে আরও ভাবতে হবে।’

কাঁটা দিয়ে যেমন কাঁটা তোলা যায়, তেমনই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আবার পরখ করে নেওয়া যায় কোন লেখাটা মানবমস্তিষ্ক লিখেছে, আর কোনটা রোবট। এমন একাধিক টুল এখন হাজির নেটদুনিয়ায়। ফলে আগামীতে চাইলেই কেউ সহজে কৃত্তিম লেখাকে মৌলিক স্বীকৃতি দিতে পারবে না। তাই পড়ুয়ারা ‘সাধু সাবধান’।

(তথ্য সহায়তা : অরিন্দম বাগ, তমালিকা দে ও দেবদর্শন চন্দ)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *