- বিদ্যুৎ রাজগুরু
বহুদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল সেই ‘সোনার কেল্লা’ দেখতে যাব। অবশেষে একদিন সেই সুযোগ এল। মেয়ে চণ্ডীগড়ে পড়াশোনা করে। সেই সুবাদেই একদিন সেখানে পৌঁছে সেখান থেকে জয়সলমের রওনা হলাম। উত্তর-পশ্চিমের মরু রাজ্য রাজস্থান। থর মরুভূমির রুক্ষতা আর নানা রাজকীয় ঐতিহ্যের এক জমজমাট বুনোট। জয়সলমের শহরটি পশ্চিম রাজস্থানের সীমান্তের প্রহরী হিসেবেও কাজ করে। পাকিস্তান সীমান্তের কাছে এই ‘স্বর্ণ নগরী’ থর মরুভূমির খুব কাছে রয়েছে। শহরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডমার্ক হল জয়সলমের দুর্গ, যাকে ‘সোনার কেল্লা’ও বলা হয়ে থাকে।
ভারতের অন্যান্য দুর্গের মতো, জয়সলমের দুর্গ কেবল একটি পর্যটন আকর্ষণ নয়। এখানে দোকান, হোটেল এবং প্রাচীন হাভেলি (বাড়ি) রয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাসিন্দারা এই এলাকায় বসবাস করেন। এখানকার ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দেখা যায়, দেওরাজের রাওয়ালের জ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকারী রাওয়াল জসয়ালকে বঞ্চিত করে তাঁর সৎভাইকে রাজা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। জয়সাল নিজের রাজধানী স্থাপনের জন্য একটি নতুন স্থান খুঁজতে গিয়েছিলেন। কথিত আছে, তখন তিনি ঋষি ঈশুলের সঙ্গে দেখা করেন। ঋষি তাঁকে জানান, যদুবংশী বংশের একজন বংশধর এই একই স্থানে একটি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। ১১৫৬ সালে রাওয়াল জয়সাল একটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করেন। ‘জয়সালমের’ নামে সেটির নামকরণ করে তিনি তাকে তাঁর রাজধানী ঘোষণা করেন। বালির সোনালি রংয়ের সঙ্গে মিল থাকায় একে সোনার কেল্লাও বলা হয়ে থাকে। দুর্গটি স্থানীয় কারিগররা রাজপরিবারের ধ্রুপদি শৈলিতে তৈরি করেছিলেন। আজও সেটি পর্যটকের কাছে খুব আদরের। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘সোন্নার কেল্লা’ যঁারা পড়েছেন, তাঁদের কাছে এটি তো খুব পরিচিত নাম।
এছাড়াও জয়সলমেরের অন্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল গাদিসার হ্রদে আলোক ও শব্দ প্রদর্শনী, জয়সলমের সরকারি জাদুঘর। এখানে সেলিম সিং হাভেলি, পট্টন কি হাভেলি, জৈন মন্দিরও রয়েছে। জয়সলমেরের প্রায় ছয় কিলোমিটার উত্তরে বড়াবাগ রয়েছে। এই উদ্যানে রাজ্যের মহারাজাদের ছত্রী বা রাজকীয় সমাধিসৌধ রয়েছে৷ যার মধ্যে দ্বিতীয় জয় সিংহের সমাধিও রয়েছে। জয়সলমের থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে তানোট মাতার মন্দির রয়েছে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তানোট প্রচণ্ড আক্রমণ এবং গোলাবর্ষণের শিকার হয়েছিল৷ তবে মন্দিরের কোনওরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় লংগেওয়ালাকে কেন্দ্র করেও এখানে অনেক কিছু শোনা যায়। সেই এলাকার বাসিন্দারা ওই সময় যেভাবে পাক হামলার জবাব দিয়েছিলেন তা এখনও এখানকার চর্চিত বিষয়। এখানে একটি মিউজিয়াম রয়েছে। টেন্টে রাত কাটানো, ধু-ধু বালিয়াড়িতে কার ড্রাইভিং, উটের পিঠে ঘুরে সূর্যাস্তের শোভা দেখা, ধূমায়িত কফির সঙ্গে পকোড়া আর রাজস্থানের সংগীত ও লোকনৃত্য এবং সংগীতের আসর এখানকার দুর্দান্ত আকর্ষণ। একবার এখানে এলে ফিরে যেতে মন চাইবে না।
জয়সলমের ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে রহস্যময় গন্তব্যস্থলগুলির মধ্যে একটি হল কুলধারা গ্রাম৷ রাতেরবেলায় এখানে প্রবেশ নিষেধ৷ গা ছমছমে পরিবেশ৷ পুরো গ্রামটি রাজস্থান আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের অধীনে রয়েছে৷ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠে৷ পর্যটকদের সুবাদে গ্রামটিকে বেশ পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে৷ টিকিট কেটে এখানে ঢুকতে হয়। গ্রামটিকে যে বেশ পরিকল্পনা করে তৈরি করা হয়েছিল তা ভালোমতো খঁুুুটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। বর্তমানে কোনও বাড়িঘরের ছাদ নেই৷ তবে বাড়িগুলিতে উঠোন, মোটা স্তম্ভযুক্ত বারান্দা রয়েছে। আধুনিক বাড়ির মতো নীচের তলায় ঘোড়ার গাড়ি রাখার ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। তবে এটি অভিশপ্ত ও ভূতুড়ে গ্রাম নামেই পরিচিত৷ কুলধারা পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের গ্রাম ছিল৷ কথিত আছে, একদা রাজার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সালিম সিং৷ গ্রামের মোড়লের সুন্দরী কন্যার প্রতি তাঁর কুনজর পড়েছিল৷ অনেকে আবার বলেন যে, তিনি নাকি ওই তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু পালিওয়াল ব্রাহ্মণরা ওই বিয়ে দিতে রাজি হননি৷ এর জেরে ব্যাপক গোষ্ঠী ঝামেলা হয়। বাসিন্দারা রাতারাতি গ্রাম ছাড়েন। বাসিন্দারা এখান থেকে রাতারাতি কোথায় চলে গিয়েছিলেন তার কোনও হদিস নাকি পরে আর পাওয়াই যায়নি। অনেকে বলেন, সেই সুন্দরীকে নাকি মেরে ফেলা হয়েছিল। তাঁর অতৃপ্ত আত্মা আজও নাকি গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।