রমেন দাস: সোনাগাছি। নাম শুনলেই ঘৃণায় মুখ কুঁচকায় অনেকের। নামটি কানে আসলে কেউ প্রসঙ্গ বদলাতে চায়। ওঁদের দেখলেই আড়চোখের চাহনি বেড়ে যায়। অথচ নাকি পতিতা পল্লির মাটি ছাড়া নির্মিতই হয় না মায়ের প্রতিমা। দিনের পর দিন উমার আরাধনায় ব্রাত্য ছিলেন তাঁরাই। বিশ্বে যেখানেই বাঙালি, সেখানেই দুর্গা আরাধনা! অথচ যৌনকর্মীদের সন্তানরা সেই আলো থেকে দূরেই থাকতেন। তবে সেই দিন ঘুচেছে। মায়ের পুজোয় মেতে ওঠে সোনাগাছি। এবার তাদের ত্রয়োদশ বর্ষের পুজো। এই তেরোটি বছর শুধু পুজোর তেরো বছর নয়, এই তেরো বছর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের তেরো বছর।
বর্ষা শেষে শরৎ এলে দেবীর বাপের বাড়ি আসার দিন এগিয়ে আসে। কিন্তু তেরো বছর আগে পর্যন্ত মাকে দেখতে মণ্ডপে যেতে পারতেন না সোনাগাছির মেয়েরা। দেবীপক্ষে নারীশক্তির এই অপমান মানতে পারেনি তাঁরা। নিজেদের এলাকাতেই দুর্গার আরাধনার সিদ্ধান্ত নেন যৌনকর্মীরা। তাতেও আপত্তি। রাতে তাঁদের শরীর ছিঁড়ে খাওয়া ‘ভদ্রবাবুরা’ই প্রশ্ন তোলেন পতিতারা করবে মায়ের পুজো? টানা তিনবছর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পুজো হয়েছে। কিন্তু তা চালানো যায়নি। কিন্তু তাঁরা হার মানেননি যৌনকর্মী। তাঁদের রক্তে যে দুর্গার শক্তি। হাই কোর্টের দারস্থ হন তাঁরা। ২০১৭ সালে মেলে অনুমতি। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। যৌন কর্মীদের সঙ্গে একে একে যুক্ত হন একে একে যুক্ত হন শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি, স্থানীয় মানুষ।
চতুর্থীর দিন সোনাগাছির দুর্গাপুজোর সূচনা। শাস্ত্রীয় নিয়মে শুরু হয় দেবীর বোধন। সপ্তমীয় ভোরে গঙ্গা থেকে জল আনা হয়, কলাবউ স্নান করিয়ে দেবীর ডান পাশে স্থাপন করা হয়। এদিন থেকেই দেবীর পূজা শুরু হয়ে অষ্টমীর সকালে পুষ্পাঞ্জলি। সোনাগাছির দুর্গামণ্ডপে তখন এক অনন্য দৃশ্য দেখা যায়। সন্ধিপুজো অনুষ্ঠিত হয় যথাযথ নিয়মে। যৌনকর্মীরা নিজেরাই ভোগ রান্না করেন। নবমী কাটিয়ে দশমীর বিকেল নাগাদ শুরু হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। ঢাকের বাজনা, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, আনন্দমুখর মানুষের ঢল মিলে এক অনবদ্য মেলবন্ধন তৈরি করে।
দূর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি সচিব বিশাখা লস্কর বলেন, “২০১৩ সাল থেকে পুজো করছি। আগে কলকাতার কোন রেড-লাইট এরিয়ার মধ্যে কোনও পুজো হয়নি। এবছর দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি তার ৩০ বছরের সংগ্রামী পথচলার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত উদযাপন করেছে। এই বিশেষ বছরে দুর্বার দুর্গোৎসব পদার্পণ করলো ১৩ তম বর্ষে। সেক্স ওয়ার্কারদের সমাজে অবহেলিত, অস্পৃশ্য’ হিসাবে গণ্য করা হত। তাই আত্মসম্মান ও সামাজিক স্বীকৃতির দাবিতে সোনাগাছিতে যৌনকর্মীরা নিজেরাই দুর্গাপুজো শুরু করেন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন