নিজস্ব সংবাদদাতা, কৃষ্ণনগর: কৃষ্ণনগরের তরুণী ঈশিতা মল্লিককে সোজা মাথায় গুলি করে দিনেদুপুরে হত্যার ঘটনার তদন্তে উঠে এল ‘ফ্রি ফায়ার’ নামের এক মোবাইল গেমের কথা। ওই গেমে রীতিমতো আসক্ত ছিল ঈশিতা খুনে অভিযুক্ত, উত্তরপ্রদেশের নেপাল সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার দেশরাজ সিং। এতটাই যে, সারাক্ষণই একটি ভার্চুয়াল বিশ্বে বিচরণ করত সে। গেমে দেখানো হয়েছে, সোজা মাথা নিশানা করে গুলি চালাতে হবে। তাতে বাড়বে পয়েন্ট। যে করেই হোক মারতে হবে প্রতিপক্ষকে। ওই গেমের দৃশ্য তার মাথায় এমন ভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে, হাতে মারাত্মক পিস্তল এসে যাওয়ার পরও কল্পনা আর বাস্তবের পার্থক্য করতে পারেনি দেশরাজ। তাই অনেকটা গেমের প্রতিপক্ষের মতোই ঈশিতার মাথায় পর পর তিনটি গুলি চালাতে একটুও হাত কাঁপেনি তার। তাকে জেরা করে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এও জেনেছে যে, শুধু তাই নয়, ভার্চুয়াল গেমেও সে রক্ত দেখতে অভ্যস্ত ছিল। তাই এত রক্ত দেখেও ঘাবড়ায়নি সে। পুলিশ জেনেছে, দেশরাজের ব্যবহার এতটাই রূঢ় ছিল যে, তার বন্ধু ও বান্ধবী অনেকেই তা পছন্দ করত না। যখন সে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, তখন ঈশিতা বুঝিয়েছিল যে, ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে মানিয়েও নিতে পারবে না। কিন্তু রূঢ় স্বভাবের দেশরাজ প্রত্যাখান মেনে নিতে না পারার কারণেই সাত মাস আগে থেকে ঈশিতাকে খুনের ছক কষে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এই ব্যাপারে কৃষ্ণনগর জেলার পুলিশ সুপার অমরনাথ কে জানান, ১৩ বা ১৪ বছর বয়সি ছাত্রদের লকডাউনের জন্য স্কুলে যেতে হয়নি। সামাজিক সম্পর্ক থেকে অনেকটাই দূরে সরে যায় তারা। তাদের অনেকেই মোবাইল গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। দেশরাজও ফ্রি ফায়ার গেমে আসক্ত ছিল। কলেজে ওঠার পরও তার অত্যন্ত হিংসাত্মক এই গেমের আসক্তি কা়টেনি। গেমের হিংসা তার কাছে মামুলি ব্যাপার হয়ে পড়েছিল। তাই সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল গেম যে সবসময় ভাল নয়, তা কী কী ক্ষতি করতে পারে, সে ব্যাপারে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝানো হবে। প্রয়োজনে তাদের কাউন্সেলিংয়েরও ব্যবস্থা করা হতে পারে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, বুধবার ঈশিতার মা ও ভাইকে কৃষ্ণনগরের জেলে নিয়ে গিয়ে দেশরাজকে চিহ্নিতকরণ বা তার টিআই প্যারেড করানো হবে। ওই তরুণীর মা ও ভাইকেও খুনের চেষ্টা করেছিল সে। যদিও ট্রিগার লক হয়ে যাওয়ায় গুলি বেরোয়নি। বুধবারের মধ্যেই দেশরাজের বাবা বিএসএফ কর্মী রঘুবিন্দরপ্রতাপ সিংকে রাজস্থানের জয়সলমেঢ় থেকে গ্রেপ্তার করে কলকাতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন পুলিশ আধিকারিকরা। দ্বিতীয়বারের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বিএসএফের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। দেশের একজন রক্ষক হয়ে কেন তিনি খুনে অভিযুক্ত ছেলেকে আড়াল করলেন, তা নিয়েও পুলিশ প্রশ্ন তুলেছে।
এদিকে, নিহত ঈশিতার দাদু ও প্রতিবেশীরা পরপর দুটি গুলির শব্দ শুনেছিলেন। ঘটনাস্থল থেকেও উদ্ধার হয়েছিল গুলির দুটি খোল। ঈশিতার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে তিনটি আঘাতের চিহ্নের উল্লেখ রয়েছে, প্রাথমিকভাবে ওগুলি ‘বুলেট ইনজুরি’ বলেই মনে করেছিল পুলিশ। তবে, তিনটি না দুটি, ঠিক ক’টা গুলির চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল ঈশিতার দেহে, সে ব্যাপারে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের কাছে আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাইল কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশ। দেশরাজের খুড়তুতো ভাই নীতিনপ্রতাপ সিংকেও উত্তরপ্রদেশের দেওরিয়ায় খুঁজছে পুলিশের একটি টিম।
পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দেশরাজ সিং ওই মোবাইল গেমটি ডাউনলোড করেছিল। পয়েন্ট বাড়ানোর জন্য শত্রুপক্ষের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালানো পছন্দ করত সে। দেশরাজ এই গেমে এতটাই পারদর্শী হয়ে যায় যে, কয়েক মিনিট করে গেমের মুহূর্ত সে ইউটিউবে ডাউনলোডও করে। প্রথম দিনই দেশরাজকে জেরা করে পুলিশ জানতে পারে যে, তার কাছে কল্পনা ও বাস্তবের জগৎ এতটাই এক হয়ে গিয়েছিল যে, বান্ধবী ঈশিতার মাথা লক্ষ্য করে তিনটি গুলি চালাতে তার কোনও সমস্যা হয়নি।