- মহুয়া বাউল
বড়লোক নিয়ে একটা কথা খুব জনপ্রিয়। ‘তুমি এই পৃথিবীতে জন্মেছ গরিব হয়ে সেটা তোমার দোষ নয়, কিন্তু যদি তুমি গরিব হয়েই মারা যাও তবে সেটা তোমারই দোষ’। অর্থাৎ, তুমিই চেষ্টা করোনি, কিংবা পারোনি তোমার ভাগ্য বদলাতে।
ভাগ্য বদলাতে সবাই চায়, আর সবাই চায় বড়লোক হতে। আমাদের সমাজে অর্থের দিক থেকে যাঁরা খুব উঁচু জায়গায় থাকেন, বিত্তশালী, তাঁদের মধ্যে স্পষ্টত দুটো ভাগ আছে। একদল তাঁরা, যাঁদের নামের পাশে বড়লোক শব্দটা জন্ম থেকেই জুড়ে থাকে। জন্মের পর অনেকের ব্যাপারে বলা হয় সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে। আর দুই, যাঁরা জন্মান গরিব ঘরে, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তাঁরা হঠাৎ করেই বড়লোক হয়ে যান।
‘কাঁচা বাদাম’ শব্দযুগল মনে আছে? বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের বাসিন্দা ভুবন বাদাম বিক্রি করতেন। যেমন আর পাঁচটা বাদামওয়ালা করেন। বাদাম বিক্রি করার সঙ্গে একটা গান গাইতেন তিনি। ‘হাতের বালা, পায়ের চুরি, সিটি গোল্ডের চেন/দিয়ে যাবেন। আজি সমান সমান বাদাম পাবেন, বাদাম বাদাম দাদা বাদাম বাদাম, বাদাম/আমার কাছে নাই গো বুবু ভাজা বাদাম, আছে কাঁচা বাদাম’। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ একজন এই গানের ভিডিও তুলে দিতেই লক্ষ লক্ষ ভিউ হয়, এমন ভাইরাল হয়ে যান ভুবন, যে তাঁকে নিয়েই চর্চা চলতে থাকে, তিনি হয়ে ওঠেন সকলের প্রিয় ‘বাদামকাকু’। তাঁর এই গানে রিলস বানান নানান জনপ্রিয় সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সাররা। সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তার জোরে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যান ভুবন, গানের প্লে-ব্যাক করার অফার পান, ভুবন থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ভুবন বাদ্যকর। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার আরেকটা অন্ধকার দিক যে আছে, ভুবন সম্ভবত সেটা জানতেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস ভাইরাল হয়, আজ যেটা ভাইরাল কাল সেটাকে রিপ্লেস করে আরেকটা কিছু ভাইরাল। সোশ্যাল মিডিয়ার জোরে যাঁরা রাতারাতি খ্যাতি পান, সোশ্যাল মিডিয়াই আবার তাঁদের টেনে নামায় নীচে। ফলে ভুবনের গান আগে যতখানি ভাইরাল ছিল আজ আর নেই। একজন সাধারণ বাদামওয়ালা, যিনি পরিশ্রম করেই তাঁর সারাদিনের আয় করতেন, তিনি শেষপর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ার এই পুতুলখেলার শিকার হলেন।
আরেকজনের কাহিনী এর চেয়েও করুণ। বিহারের বাসিন্দা সুশীল কুমার। বিহারের তরুণ এই সুশীল কুমার একসময় ইউপিএসসির প্রস্তুতি নিতেন, তাঁর স্বপ্ন ছিল আইএএস অফিসার হওয়ার। কিন্তু তাঁর জীবন বদলে দেয় ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ নামের শো। বিগ বি’র মুখোমুখি হয়ে কেবিসিতে গিয়ে সব প্রশ্নেরই ঠিক জবাব দিয়ে পাঁচ কোটি টাকা েজতেন সুশীল। ফলে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যান তিনি। রাতারাতি কোটিপতি হয়ে লাইফ স্টাইল বদলে যায় তাঁর। তিনি প্রচারমাধ্যমের আলোয় চলে আসেন, সেলেব্রিটি তকমা পান। নানান অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যাওয়া শুরু করেন, ব্যস্ততা এত বেড়ে যায় যে, তাঁর পড়াশোনার প্রস্তুতি বন্ধই করে দেন। প্রচারে টিকে থাকতে নানা জায়গায় মোটা অঙ্কের অর্থ দান করা শুরু করেন সুশীল, সেইসঙ্গে চলে যেখানে সেখানে মোটা বিনিয়োগ করা। ফলে প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। পরিবারের লোকেরা তাঁকে সাবধান করলেও, জনপ্রিয়তার ভূত তখন তাঁর মাথায় চড়ে গিয়েছে। ফলে তিনি কারোর কথাই শোনেননি। স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, স্ত্রীও তাঁকে ছেড়ে চলে যান। ধীরে ধীরে সমস্ত টাকা খুইয়ে ফেলেন সুশীল। যে প্রচারমাধ্যম তাঁকে হিরো বানিয়েছিল সেই প্রচারমাধ্যমের আলো তাঁর থেকে দূরে সরে যায়। এক সময় রাতারাতি বড়লোক হওয়া সুশীল এখন সর্বস্বান্ত প্রায়। দুটো গোরুর দুধ বেঁচে সংসার চালান তিনি, নিজেই থাকেন প্রচারমাধ্যমের আলো থেকে দূরে। নিজের জীবন সম্পর্কে সুশীল নিজেই এখন বলেন, ‘হয়তো রাতারাতি বড়লোক হওয়াটাই কাল হয়েছিল আমার।’
আমেরিকাতে খোদ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একপ্রকার ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে ইদানীং চর্চায় আছেন বিশ্বের অন্যতম বড়লোক এলন মাস্ক। নিজের জীবনে অবশ্য নিজের পরিশ্রমের জেরেই আধুনিক প্রযুক্তি জগতের এক উজ্জ্বল নাম হয়েছেন, এটা একটা গুণ। তিনি টেসলা, স্পেসএক্স, নিউরালিংক এবং এক্স (সাবেক টুইটার)-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধান। বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রসার থেকে মহাকাশ ভ্রমণ, সব ক্ষেত্রেই তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। কিন্তু মাস্কের আবার কিছু দোষও আছে। কর্মক্ষেত্রে তিনি প্রায়ই কঠোর আচরণ করেন বলে অভিযোগ আছে। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর টুইট অনেক সময় বিভ্রান্তি ছড়ায় ও শেয়ার বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তিনি নিয়মকানুনকে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছেন, বিশেষত মার্কিন সিকিউরিটি কমিশনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। অনেক প্রকল্পে একসঙ্গে জড়িয়ে থাকায় কোনওটি কখনও অতিরিক্ত মনোযোগ পায় না। ইদানীং রাজনীতিতেও নতুন দল গঠন করে নেমেছেন মাস্ক, অনেকে এই ব্যাপারটাকে তাঁর হঠকারিতা বলেই মনে করছেন।
বিগত দশকের সবথেকে আলোচিত কোর্ট কেস ছিল বিশ্ববিখ্যাত হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ এবং তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী অ্যাম্বার হার্ডের মধ্যে। দুজনেই অভিনেতা, দুজনেই বড়লোক। ফলে প্রচারমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই মামলাটিকে কভার করতে। ফিল্মস্টার দম্পতির মধ্যকার এই কোর্ট কেস প্রচারমাধ্যমের জেরে ঢুকে পড়ে সাধারণ মানুষদের ঘরের মধ্যে। ফিল্মস্টার বনাম ফিল্মস্টার, বড়লোক বনাম বড়লোকের এই লড়াইতে শেষপর্যন্ত কে জেতে তা দেখার জন্য উৎসুক হয়ে পড়ে জনতা। শেষপর্যন্ত অবশ্য জনি ডেপের পক্ষেই যায়। শোনা যায়, তিনি ১০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পান। তবে অনেক শিক্ষণীয় ব্যাপারও আছে। এই যেমন রতন টাটা। প্রচুর বড়লোক হয়েও জীবনটা কাটিয়েছেন সাধারণের মতো। নিজের উপার্জনের একটা বড় অংশই অবলীলায় দান করে দিয়েছেন। বিল গেটসও তাই। মুকেশ আম্বানিরা প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। কীভাবে টাকা রোজগার করে নিজের পায়ের তলার মাটিটা আরও শক্তপোক্ত করা যায় সেই ছবিটাও সবাইকে দেখিয়েছেন।
পরিশেষে এই লেখা শেষ করি সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর একটি লেখার নাম সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে, সেই লেখার নাম-‘অর্থমনর্থম’। অর্থাৎ এই জগতে অর্থই আসল অনর্থের মূল। তাই হয়তো ঠাকুরের সেই উক্তিই আমাদের পাথেয়, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’।