চারুবাক: সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ তাঁর অন্যতম সেরা রচনা যেমন, তেমনি বাংলা সাহিত্যেও এই উপন্যাস একটি বিশিষ্ট স্থান নিয়ে রয়েছে এখনও। মানুষের জন্ম – মৃত্যু, জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, জীবন – যাপন, একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্কের স্বাভাবিকতা বা অস্বাভাবিকতা সব কিছুই ঘটে চলে যেনো এক অদৃশ্য সুতোর টানে। সেই সুতো কে টানে – পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, সহজাত বিশ্বাস, সংস্কার, সময়, না কোনও অদৃশ্য শক্তি বা ঈশ্বর, নাকি নিজেরাই নিজেদের চলার রাস্তা খুঁড়তে খুঁড়তে এগিয়ে চলি! এ এক উত্তরহীন চিরন্তন জিজ্ঞাসা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসাবে বেছে নিয়েছেন স্বাধীনতাপূর্ব বাংলার এক দীন দরিদ্র গ্রাম। যেখানে শিক্ষার আলো তেমন ভাবে তখনও এসে পড়েনি।
সেই গ্রামের তরুণ শশী কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে বিলেত যাবার আগে কিছুদিনের জন্য ফিরে আসে। কারণ তাঁর মন ও শরীরের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে এই গ্রামের সেনদিদি (অনন্যা), বয়স্ক বাবা (শন্তিলাল), সূর্যের পূজারী গ্রামের জাঁদরেল যাদব পণ্ডিত (ধৃতিমান), আর প্রতিবেশী বৌদি হলেও ‘বউ’ নামে ডাকা উচ্ছ্বল তরুণী কুসুম (জয়া আহসান), চঞ্চলা কিশোরী মোতি (সুরাঙ্গনা)। এবং অবশ্যই রয়েছে গাছগাছালি পাখপাখালিতে ভরা গ্রাম, নদীর পাড় এবং একদল সহানুভূতিশীল প্রতিবেশী। শরৎচন্দ্রের এক গ্রাম যেন। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় সনাতন গ্রামীণ বাংলার এমন একটি পটভূমি ও হাফ ডজন চরিত্রের মাকড়সার জালের মত জড়িয়ে থাকার গল্পটি পেয়ে লেখকের বক্তব্যকেই সরল সাদাসিধে ন্যারেটিভ তুলে এনেছেন পর্দায়। তাঁর সেই বর্ণনার মধ্যেই লেখকের জিজ্ঞাসা, অভিজ্ঞতা ও প্রশ্নগুলোকে তিনি বুনে দিয়েছেন কাঁথায় সুন্দর সেলাইয়ের মতো করে। সুমনের সেই শৈল্পিক বুননটাই ছবির ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ছড়িয়ে রয়েছে!
সায়ক ভট্টাচার্যের আলোকচিত্র সেই পুরনো গ্রাম বাংলার নদী, আকাশ বাতাস, বনানী ছাড়াও ভগ্নপ্রায় জমিদার ও অবস্থাপন্ন শশীর বাড়ির পাশাপাশি দরিদ্র কুসুমের পরিবার, গ্রামের বটতলা সব দিকেই সমান নজর দিয়েছে। যা বহুদিন পর নিশ্চিন্দিপুরের কথা মনে করিয়ে দেয় যেন। কিন্তু এই গ্রাম একটু বর্ধিষ্ণু, ফারাক এটুকু। জীবন চলে নিজের চলার ছন্দে। শশীর সঙ্গে কুসুমের সম্পর্কের চোরাটান বেশ সুন্দর বজায় রেখেছেন সুমন তাঁর চিত্রনাট্যে। যৌনতার আড়ালটি যখন ভাঙার উপক্রম, তখনই কুসুমের অমোঘ সংলাপ “লোহা লাল গরম করে ফেলে রাখলে একদিন ঠান্ডা হয়ে যায়।” সেনদিদির সঙ্গে শশীর বন্ধুর মতো সম্পর্কটাও অমলিন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সুমন। যাদব পন্ডিতের স্বেচ্ছামৃত্যু যে বেশি ডোজের আফিম খেয়ে, তাঁকে বাঁচাতে না পারার অপরাধবোধ পীড়া দেয় শশীকে।
এবং শেষপর্যন্ত শশীর গ্রাম ছেড়ে যাওয়া হয়না, তাঁর বাবার পরিকল্পনায়। সেটা সে বুঝতেও পারে, কিন্তু ভবিতব্য বা ভাগ্য বলে মেনে নিয়ে গ্রামের একমাত্র হাসপাতালের দায়িত্ব পালন করে, আর সাইকেলে করে রুগী দেখে বেড়ায়। গোধূলিতে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে একাধিক দেখা শেয়ালটির মতো আর স্বগতোক্তি শুনতে পায় “নিজেই নিজের পথ কেটে চলি আমরা, নাকি কোন অদৃশ্য শক্তি ও পরিস্থিতি আমাদের চালিয়ে নিয়ে যায়।” লেখকের আন্তরিক স্বরের সঙ্গে মিশে যায় শশী ও পরিচালক সুমনের সমস্বর। আর এখানেই ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ হয়ে ওঠে সমকালীন। এই মুহুর্তে আমরা বুঝতে পারি নিজেদের কাছেই আমরা কেমন যেন অসহায় পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়ি। সুমনের ছবি তাই শেষ মুহূর্তে হয়ে ওঠে কালহীন সময়ের এক দলিল।
সুমনের স্বাভাবিক পরিচালন শৈলীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে প্রধান সব কটি চরিত্রশিল্পী। সবকটি চরিত্রশিল্পীর সুষম অভিনয়। প্রথম নাম অবশ্যই আবীর চট্টোপাধ্যায়ের। তিনিই লেখক-কথকের ভূমিকায়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাঁর স্বাভাবিক অভিনয়। কুসুমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাওয়ার মুহূর্তেও দ্বিধাজড়িত অস্বস্তি, সেনদিদির সঙ্গে খুনসুটি করা, যাদব পন্ডিতের সঙ্গে কথার লড়াই সবগুলো মুহূর্তেই আবির অন্তরের দ্বন্দ্ব মুখের মধ্যেই ফুটিয়ে তুলেছেন। কুসুমের আলগা লাবণ্য ও দুষ্টুমি জড়ানো যৌনতার ইশারাগুলোর প্রকাশ সুন্দর। সেনদিদির চরিত্রে অনন্যা চট্টোপাধ্যায় অসুস্থ শরীরের যন্ত্রণার সঙ্গে মনের লড়াইয়ের ব্যাপারটাও জীবন্ত করে তুলেছেন ক্যামেরার সামনে। সুরঙ্গনার মোতি লাবণ্যময়ী।
কিন্তু কুমুদের চরিত্র চিত্রনাট্যে তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় পরমব্রত শুধু যেন বংশীধারি কেষ্ট ঠাকুর হয়েই রইল। বাবার চরিত্রে শন্তিলাল মুখোপাধ্যায়ের এবং পণ্ডিতের ভূমিকায় ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় এককথায় জবরদস্ত। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ অবশ্যই নাটকীয় মুহূর্তগুলোকে যেমন হাইলাইট করেছে, তেমনই সমস্ত গানের ব্যবহারও কাঙ্ক্ষিত ব্যঞ্জনা এনে দেয়। অনেকদিন পর সুমনের এই ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ সিনেমার ফ্রেমে সাহিত্যের মেজাজ ফিরিয়ে আনল যেন।