‘সুবর্ণরেখা’-র তীরে

‘সুবর্ণরেখা’-র তীরে

জীবনযাপন/LIFE STYLE
Spread the love


শ্যামল চক্রবর্তী: কমলকুমার মজুমদার ভর্তি আছেন পিজি হাসপাতালের কেবিনে। বন্ধুকে দেখতে হাজির ইন্দ্রনাথ। তখন বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর নৌকার মতো দু’মুখো নিপ্‌ল কাচের বোতল পাওয়া যেত। কমলকুমারের জন্য ফলের রস বেরিয়ে এল ইন্দ্রনাথের ঝোলা থেকে। রসটা ফিডিং বোতলে ভরা। হাতে নিয়েই চুকচুক করে বোতলের রস চুষছেন ‘গোলাপসুন্দরী’-র লেখক কমলকুমার মজুমদার। আচমকা ওষুধ আর থার্মোমিটার হাতে পর্দা ঠেলে কেবিনে ঢুকে এলেন একজন নার্স– ‘পেশেন্ট কি শিশু? বোতলে করে কী খাওয়াচ্ছেন ওঁকে?’ কটমট করে ইন্দ্রনাথের দিকে তাকাচ্ছেন সিস্টার।
‘আজ্ঞে, মুসুম্বির রস, দুর্বল শরীরে একটু ফলের রস বল বাড়াবে!’– ভাজা মাছ উল্টে খেতে না-জানা মুখে বলছেন রোগীর পরম বান্ধব।

‘ফলের রস, তাই না! গন্ধে বমি উঠে আসছে আমার!’ এ-কথা বলেই নার্স দিদিমণি ঝটকায় বিছানায় শুয়ে থাকা কমলকুমারের হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিলেন। ‘অর্জুন, কেবিন মে আ যাও।’ গলা চড়িয়ে দরজার কাছ থেকে জমাদারকে ডাকছেন সিস্টার। ‘এই যে বুড়োখোকা, এখনই বেরিয়ে যান কেবিন থেকে, নইলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার লোক ডাকব।’– ইন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে তর্জনী তুললেন সিস্টার।
‘না মানে, রসটা ফেলে দিয়ে বোতলটা আমাকে ফেরত দিলে হত না? ২০ টাকা দিয়ে সকালেই কিনেছি।’ নিষ্পাপ গলায় বলছেন ইন্দ্রনাথ!
‘লজ্জা করে না আপনার? বন্ধুকে ফিডিং বট্‌লে ভরে বাংলা মদ খাওয়াচ্ছেন!’
‘সঙ্গে কচি ডাবের জল মেশানো আছে। ডাব তো জানতাম রোগীর পক্ষে ভাল।’
‘গেট আউট। এখনই বেরিয়ে যান এখান থেকে।’ রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ইন্দ্রনাথের দিকে তেড়ে এলেন সিস্টার। আর ঝুঁকি নিলে মহিলার হাতের থাপ্পড় এসে পড়বে গালে! বুঝতে পেরে এক ছুটে ইন্দ্রনাথ মজুমদার পগারপার!

এই গল্পটা বুড়োদা, ইন্দ্রনাথ মজুমদারের একান্ত আড্ডায় শোনা। বলতে-বলতে স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠছে বুড়োদার মুখে। ‘সুবর্ণরেখা’-র বাইরে দুটো মোড়ায় বসে আছেন কে. জি. সুব্রহ্মণ‌্যম (মানিদা) আর পাউচ থেকে তামাক বের করে কাগজে সিগারেট পাকানো অরুণ নাগ।
‘সুনীল ওকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছে। একটা কাজ করছে স্বপ্ন নিয়ে। ডাক্তারিও করে, তাই পিজি হাসপাতালের গল্পটা ওকে শোনাচ্ছিলাম।’– বুড়োদার কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠছেন মানিদা। অরুণ নাগ হাসেন না, হাসি চাপতে গিয়ে হাতে বানানো সিগারেটে টান দিতে ভুলে যান! আড্ডা ঘুরে যাচ্ছে অন্যদিকে।
‘এই লোকটা বিচিত্র স্বপ্ন শুনিয়ে আমাদের সম্মোহিত করার তালে আছে!’– নিভে যাওয়া সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-র টীকাকার।
‘স্বপ্ন ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং, খুব এনজয় করি। গিরীন্দ্রশেখর বসুর স্বপ্ন বইটা নিশ্চয়ই পড়েছেন?’
‘শুধু পড়েনি, গুলে খেয়েছে! সুনীল বলছিল ও নাকি খুব ফ্রয়েডের ভক্ত!’– বইয়ের দোকানের ভিতর থেকে ফিরে এসে মোড়ায় বসলেন বুড়োদা।
‘আপনার কাছে একটা প্রশ্ন আছে। সচেতন আর অবচেতনের দ্বন্দ্বে কীভাবে পৃথিবীর একের-পর-এক বিখ্যাত আবিষ্কার হয়েছে স্বপ্নে, একটু বুঝিয়ে দিন।’
‘ভাল প্রশ্ন করেছে। অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের শেষ সংকেত জুগিয়েছে স্বপ্ন।’ খেই ধরিয়ে দিলেন ইন্দ্রনাথ।
‘শোপেনহাওয়ারের আবিষ্কারটা বললে না ইন্দ্র!’ বললেন বিশ্বভারতীর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক দীপঙ্কর সরকার।
‘দীপঙ্কর, আমার মনে হয় স্বপ্ন যেন মেয়েদের মাথার চুলের দুটো বিনুনি। একটা বাস্তব অথবা অবচেতন, আর-একটা অচেতন মনের কথা। আঁকতে আঁকতে চিত্রকর না-জেনেই আচম্বিতে ঘোরের মধ্যে এঁকে ফেলেন কালজয়ী ছবি, হয়তো সেভাবেই আবিষ্কার হয় স্বপ্নে।’
‘পদার্থবিজ্ঞান কী বলে দীপঙ্কর?’
‘দুর্গাপুজোর আলোকসজ্জার কথা ভাবো ইন্দ্র। মিনিয়েচার আলোর নির্দিষ্ট ছন্দে একটা ছবি জ্বলছে আর নিভছে। ছন্দ ভেঙে একটা আশ্চর্য ছবি জ্বলে উঠতে পারে অকস্মাৎ। বেনজিনের গঠনের কথা ভাবতে-ভাবতে কেকুলে একটা নিয়মভাঙা কুণ্ডলী পাকানো সাপকে স্বপ্নে পেয়ে গেলেন। ঘুম ভেঙে আবিষ্কার করে ফেললেন অর্গ‌্যানিক কেমিস্ট্রির বেনজিন রিং।’
‘কথাগুলো নোটবুকে লিখে নাও, তোমার কাজে লাগবে।’ বললেন ইন্দ্রনাথ।

১৯৮৪-তে তৈরি হওয়া শান্তিনিকেতনে ইন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘সুবর্ণরেখা’ শুধু তো একটা বইয়ের দোকান ছিল না, ছিল দুষ্প্রাপ্য পুরনো বইয়ের এক অমূল্য ভাণ্ডার। কেউ কোনও নতুন কাজ করছে জানতে পারলে নিঃশব্দে সাহায্য করতেন, খোঁজ দিতেন প্রয়োজনীয় বইয়ের, বিষয়টিতে গভীর জ্ঞান আছে এমন মানুষের। যথাসম্ভব আড়ালে রাখতেন নিজেকে। জান কবুল করে প্রচুর পরিশ্রমে, অদম্য উৎসাহে ১৯৬৮ সালে মহাত্মা গান্ধী রোডে গড়ে তুলেছেন কলকাতার প্রকাশন সংস্থা ‘সুবর্ণরেখা’। অমর্ত্য সেন থেকে অশোক রুদ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অশোক মিত্র, সোমনাথ হোড়, গৌতম ভদ্র, সন্তোষ রানা– প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানীগুণী মানুষে ভরা ছিল ইন্দ্রনাথ মজুমদারের বন্ধুবৃত্ত। প্রকাশক হিসাবে পরম মমতায় ছেপেছেন কত অমূল্য বই। গৌতম ভদ্র-র ‘মুঘল যুগে কৃষি অর্থনীতি ও গণবিদ্রোহ’, সরলাদেবীর ‘জীবনের ঝরাপাতা’, রঞ্জন গুপ্ত-র ‘রাঢ়ের সমাজ অর্থনীতি ও কৃষকবিদ্রোহ’, মিহির সেনগুপ্ত-র ‘বিষাদ বৃক্ষ’, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের ‘অ্যানালস অফ বেঙ্গল’-এর বঙ্গানুবাদ ‘গ্রাম বাংলার ইতিকথা’। বিশ্বাস করতেন বইয়ের নির্মাণ এক শিল্প। পাঁচ দশক জুড়ে প্রকাশিত ‘সুবর্ণরেখা’-র বইগুলো হাতে তুলে নিয়ে সমঝদার বাঙালি পাঠক বুঝে গিয়েছে কত বড় পুস্তকশিল্পী প্রকাশক ইন্দ্রনাথ মজুমদার।

ইন্দ্রনাথ মজুমদার। ছবি: সঞ্জীত চৌধুরী

শান্তিনিকেতনে গেলেই টানত ‘সুবর্ণরেখা’। একদিন যেতেই হন্তদন্ত হয়ে কোথা থেকে এসে মৃদু হাসলেন আড্ডায় দেখে। ‘ভেতরে এসো। এত যে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করো, এই বইটা পড়েছ?’ এই বলে হাতে তুলে দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসুর ‘সব পেয়েছির দেশে’। বোলপুরের উপর দিয়ে ফিরতে ফিরতে কতবার নেমে পড়েছি ইন্দ্রনাথ মজুমদারের টানে। ‘সুবর্ণরেখা’-এ গেলেই সপরিবার অনেক বই কেনা হয়ে যেত। দোকানটা থেকে বাইরে আসছি, হঠাৎ দেখা প্রাক্তন মুখ্যসচিব প্রসাদরঞ্জন রায়ের সঙ্গে।

‘আপনার বই যে শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনাথদার দোকানে এসে পেয়ে যাব, ভাবতেই পারিনি!’– হাসছেন প্রসাদরঞ্জন। কেয়াফুলের গন্ধে ভরে উঠছে বুক। ২০১১ সালের দোল। সকালের অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসতেই আবির মাখিয়ে দিলেন কপালে। জীবনের শেষ দোল খেলতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গিয়েছিলেন সেবার। পরের বছর দীপাবলিতে মাটির প্রদীপের অপার্থিব আলোয় সেজে উঠেছে ‘সুবর্ণরেখা’। তবে ‘এখন সব অলীক’। বইমেলায় স্টলের বাইরে সাদা খাদির ফতুয়ায় পুরনো বইয়ের গন্ধ মেখে আর বসে থাকেন না ইন্দ্রনাথ!

(মতামত নিজস্ব)
লেখক চিকিৎসক
shml.cnmc83@gmail.com



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *