বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: ‘হইচই’-তে সদ্য মুক্তি পেয়েছে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও পার্নো মিত্র অভিনীত ওয়েব সিরিজ ‘ভোগ’। অভীক সরকারের লেখা গল্পটি ইতিমধ্যেই খুব জনপ্রিয় অডিও স্টোরির দাক্ষিণ্যে। ছয় এপিসোডের এই সিরিজে খুব ভালো করেই গল্পটি বিস্তার করেছেন পরিচালক। একটানে সিরিজটা দেখা হয়ে যায়। যেটা সবচেয়ে লক্ষণীয় সেটা হল, যেভাবে গল্পের পরিবেশ, মুডবোর্ড এবং চরিত্রগুলো ডানা মেলে। গল্পটার মধ্যে একটা ডার্কনেস আছে, সেই অন্ধকার গোটা সিরিজ জুড়ে ছেয়ে থাকে কুয়াশার চাদরের মতো। আর তার সঙ্গে একটা ক্লস্ট্রোফোবিক পরিবেশ তৈরি করা হয়, দেখতে দেখতে মনে হবে এই আঁধার থেকে মুক্তি নেই। সেটা যেমন সেট, আলোর মতো টেকনিক্যালিটি ব্যবহারে তৈরি করা, তার চেয়েও বেশি বোধহয় চরিত্রদের বিন্যাস, অভিনয় এবং বাচনভঙ্গিতে। বিশেষ করে অনির্বাণ ভট্টাচার্যর অভিনয়। সে কথায় আসছি পরে।
‘ভোগ’ গল্পটা আমি অডিও স্টোরিতে শুনিনি, সিরিজ দেখার আগে গল্পটা পড়েছি। পড়ার পরে আমার নিজের কিছু কথা মনে হয়েছিল। যে দেবী মূর্তিকে ঘিরে এই গল্প সেটা দশমহাবিদ্যার নবম রূপ দেবী মাতঙ্গীকে নিয়ে। বলা হয়, দেবী মাতঙ্গী সরস্বতীর তান্ত্রিক রূপ। এই দেবীর উচ্ছিষ্ট, ফেলে দেওয়া, যা কিছু বর্জিত, সেই সব কিছু বড় প্রিয়। অশুদ্ধ-শুদ্ধর এক যোগাযোগ সেতু এই দেবী মাতঙ্গী। তাঁকে জ্ঞানের দেবীও বলা হয়, তিনি ভক্তের মধ্যে বৌদ্ধিক দিক উন্মোচন করেন। গল্প পড়ে এটাই মনে হয় মাতঙ্গীর প্রতি সুবিচার হয়নি। তার নানান দিক আছে, আছে সাব অল্টার্ন পটভূমি, সেসবের ছোঁয়া গল্পে নেই। গল্পে দেবীর একরৈখিক চিত্রায়ণ আছে আর আছে নায়ক অতীনের দেবীর পুজো নিয়ে পাগলামি। পরিচালক পরমব্রতও মূল গল্পের মতো প্রথমটা নিয়ে বিশেষ এক্সপেরিমেন্ট করেননি। যদিও এক্সপেক্ট করেছিলাম। কিন্তু অতীনের চরিত্রটায় একটা সূক্ষ্ম স্তর যোগ করেছেন। সেটা এতটাই সূক্ষ্ম যে, আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। বাপ-মা মরা এই অবিবাহিত যুবকের একাকীত্ব, পরমব্রত আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। গল্পে আছে সে বিয়ে করে না, কিন্তু কেন? সিরিজে দেখি অনির্বাণের সংলাপে তার ব্যাখ্যা, স্বাধীনতা যাতে খর্ব না হয়। অনির্বাণ এমনভাবে সংলাপটা বলেন, তাতে মনে হয় তিনি যে এই স্বাধীনতা নিয়ে খুব স্বস্তিতে বা সুখে এমনটা নয়। অফিসের মহিলা কর্মীর দিকে তাকিয়েও তাকায় না। মৃত বাবা-মায়ের ছবিতে ফুল দিতে গেলে মনে হয় মায়ের প্রতি ছেলের টান বেশি। বাড়ির বহু পুরনো কাজের লোক মাতৃসম পুষ্পর সঙ্গে তার স্নেহের ভাষা এবং পিতৃসম পাড়ার কাকা ভবেশবাবুর সঙ্গে ফর্মাল ব্যবহার, অতীনের মনের অন্ধকার দিকটাই দেখায়।
দেখতে দেখতে মনে হয় এই একা থাকা সে যেন নিজের ওপর চাপিয়ে নিয়েছে শাস্তি হিসাবে। নিজের মায়ের মৃত্যুশোক সে পেরিয়ে যেতে পারেনি, প্রসেস করতে পারেনি। প্রথম থেকেই তার চেহারা দেখলে মনে হয়, তার কাল অশৌচ এখনও চলছে এবং দেবীমূর্তি পেয়ে যাওয়ায় এই শোক এক ধরনের অবসেশনে পরিণত হয়। অনেক বছর ধরে জমিয়ে রাখা দুঃখ এক ধাক্কায় বেরোলে সেটা আশপাশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না। যে দুঃখ বইছে তার ক্ষতি করে, তার কেয়ারগিভার, আশপাশের মানুষগুলোরও ক্ষতি করে। অনির্বাণ ভট্টাচার্য তাঁর সমস্ত শরীর দিয়ে অতীনের এই দিকটা যেন তুলে ধরতে চেয়েছেন। ছাইয়ের মতো বিষণ্ণতা তার দুই চোখে, মিথ্যে হাসি টের পাওয়া যায় গলার ক্লান্ত, শ্লথ স্বরে, বিষাদ বইতে বইতে একটু যেন নুইয়ে পড়া, আনন্দ-সুখ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা এক মানুষ। সেখান থেকে তার রূপান্তর ঘটে যখন দেবীমূর্তির আরাধনায় ক্রমশ মগ্ন হতে থাকে। তার গলার স্বর জেগে ওঠে, স্থির হয়, ঘোলাটে চোখ জীবন্ত হয়ে ওঠে যখন সে দেবীমূর্তির আরাধনায় মত্ত। অতীনের মায়ের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল? জানতে ইচ্ছে করে। এক ধরনের পজেসিভ, অবসেসিভ সম্পর্ক থাকলেও অবাক হব না। সেই রূপান্তর এবং এই সমস্ত সম্ভাবনার ইঙ্গিত অনির্বাণ ভট্টাচার্য তৈরি করেছেন তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে। এবং মানুষের অন্তরের না-পাওয়া যদি ধার্মিক অবসেশনে পর্যবসিত হয়, তাহলে কী হয়? আমরা সবাই জানি। আশপাশের প্রেতাত্মা জেগে ওঠে কি না জানি না, তবে নিজের ভিতরের অশুভ শক্তি জেগে ওঠে তা নিশ্চিত। তাই পরমব্রত পরিচালিত ‘ভোগ’ আমার কাছে অনেক বেশি সাইকোলজিক্যাল। আর যারা ভয় পেতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে মাতঙ্গীর একপেশে ভৌতিক রূপ। তবে ওই পিশাচ রূপের থেকেও ভালো লাগল পার্নো অভিনীত ‘ডামরি’কে। স্বল্প সংলাপে, তাঁর উপস্থিতি দিয়ে তিনি সমান্তরাল দুই পৃথিবীর মধ্যে এক ধূসর ছায়াপথ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আসলে ভূতের ছবিতে যতক্ষণ ভূত দেখা যায় না, ততক্ষণই ভয় পাওয়ার রোমাঞ্চ জেগে থাকে। যারা অডিও স্টোরি শুনেছেন আমার মনে হয় তাদেরও ভালো লাগবে পরমব্রতর ‘ভোগ’। তবে আমার একটাই আফসোস, এমন এক ফেমিনিস্ট সাব অলটার্ন দেবীকে সেভাবে ব্যবহার করতে দেখলাম না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন