সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: জঙ্গলমহল পুরুলিয়ায় আদিবাসীদের জমি বেহাত হওয়ার ঘটনায় তদন্ত যত এগচ্ছে, ততই ‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে’ বেরচ্ছে। শুক্রবার আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরে ওই ঘটনার শুনানি ছিল। এই ঘটনায় অভিযুক্ত ধৃত দুই জমি মাফিয়া সংশোধনাগারে থাকায় তাঁরা হাজির ছিলেন না। তবে তাঁদের প্রতিনিধিরা ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কোনও কিছুই জানেন না বলে জানিয়ে দেন। আর এই শুনানি থেকেই তদন্তে উঠে আসে এই জমির সিন্ডিকেটরাজ, যা ২০১৮ সাল থেকে সক্রিয়। আর সেখানে তৎকালীন সময়ে আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর থেকে নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রি দপ্তর, ভূমি ও ভূমি সংস্কার থেকে সেই সময়কার পুলিশ আধিকারিকরা যুক্ত বলে বিভিন্ন দপ্তরের তদন্তে উঠে আসছে।
ওই সময় থেকে একেবারে ২০২৫ পর্যন্ত ধৃত জমি মাফিয়ারা হাজার-হাজার ডেসিমেল জমি ক্রয়-বিক্রয় করে। এই ঘটনায় পুরুলিয়া মফস্বল থানার ছররার বাসিন্দা যার মাধ্যমে রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছে সেই বাপি বন্দ্যোপাধ্যায়ও ২০২১ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ৪০৩ ডেসিমেল জমি কিনেছেন। তার চেয়ে ঢের বেশি জমি বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ। এছাড়া ধৃত দুই মাফিয়া অরূপ বড়াল ২০১৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত জমি ক্রয় করেছেন ১৩৪৬ ডেসিমেল। বিক্রি হয়েছে ৬৪৪ ডেসিমেল। ধৃত আরেক মাফিয়া সন্তোষ মুখোপাধ্যায় ২০১৮ থেকে জমি ক্রয় করেছে ৭৭০ ডেসিমেল। বিক্রি করেছে ৯৪৭ ডেসিমেল। সেইসব জমির তদন্ত করছে প্রশাসন।
পুরুলিয়া মহকুমাশাসক (সদর) তথা আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক উৎপলকুমার ঘোষ বলেন, “অভিযোগ পক্ষের সমস্ত কথা বিস্তারিত শোনা হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে রেজিস্ট্রি দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আরও একবার শুনানি প্রয়োজন রয়েছে। এই ঘটনায় আইনত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।” পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে এই জমি সিন্ডিকেটরাজে প্রায় ৫০ টির বেশি দলিল হয়েছে। যা সম্পূর্ণরূপে বেআইনি এবং বাতিল হবে। আর এতেই সমস্যায় পড়েছেন বহু নিরীহ মানুষজন। কোনও কিছু না জেনেই জীবনের সমস্ত সঞ্চয়-সহ ঋণ নিয়ে যাঁরা বাড়ি তৈরি করেছেন, শুনানিতে তাঁরাও হাজির ছিলেন। তাঁদের কথাও শুনেছে প্রশাসন।
পুরুলিয়ার পুর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটবাঁধ এলাকার বাসিন্দা ওরাং জনজাতির পবিত্র কেড়িয়ারের প্রায় ৯০ ডেসিমেল জমি সাধারণ শ্রেণির নামে রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার ঘটনা ২০২৩ সাল নাগাদ পীড়িত পরিবার জানতে পারলেও অভিযোগ হয়নি। তবে তারা ওই জমি মাফিয়াদের কাছে প্রতিবাদ করে আসছিলেন। কিন্তু কেউ কোনওরকম সাড়া দেননি বলে অভিযোগ। এই জমি রয়েছে সোনাইজুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে। যাঁরা কোনও কিছু না জেনে এই জনজাতির জমি কিনেছেন, তাঁরা এদিন জমির মালিককে প্রশ্ন করেন কেন তাঁরা তাঁদেরকে জানাননি? তাহলে তাঁরা এই ভুল করতেন না। ওই শুনানিতে হাজির থাকা অবর জেলা নিবন্ধন আধিকারিক কৌশিক রায় বলেন, “শুনানি হয়েছে। অভিযোগকারী তাঁদের কথা জানিয়েছেন। আমাদের যা জানতে চাওয়া হয়েছে, তা আমরা জানিয়েছি।”
এই ঘটনার তদন্তে টামনা থানার পুলিশ বিভিন্ন দপ্তরের কাছেই রিপোর্ট চেয়ে সবকিছু খতিয়ে দেখে তদন্ত করছে। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই ঘটনায় মামলা রুজু হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তদন্ত চলছে।” এদিনের শুনানিতে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর জানিয়েছে, ওই জমির তাদের কাছে কোন রেকর্ডই নেই। আর এটাই ভাবিয়ে তুলেছে আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগ-সহ পুলিশকে। জমির রেকর্ড নেই, অথচ সেই জনজাতিদের জমি সাধারণ শ্রেণির মধ্যে বিক্রি হয়ে গেল কীভাবে? রেজিস্ট্রি অফিস কী করছিল? যে সময় ধরে এই জমিগুলির একের পর এক রেজিস্ট্রি হয়েছে, সেই সময় দায়িত্বে কারা ছিলেন, তা খুঁজে প্রয়োজনে তাদের সঙ্গেও কথা বলবে প্রশাসন।