দাবায় রাশিয়ার একাধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সাম্প্রতিক ফিডে তালিকায় একজনও রুশ দাবাড়ু নেই। এদিকে ভারত থেকে তিনজন!
মধ্যযুগে রাশিয়ার উত্তরে নবগোরোদ রিপাবলিক বলে একটি স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব ছিল। পশ্চিমে গাল্ফ অফ ফিনল্যান্ড থেকে পুবে উরাল পর্বতমালার উত্তর দিশা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই দেশের ভৌগোলিক সীমা। পঞ্চদশ দশকে রাশিয়া আধিপত্য বিস্তার করে এ দেশের উপর। নবগোরোদ হারায় স্বাধিকার। পরবর্তী সময়ে নবগোরোদে যখন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য হয়েছে, দেখা গিয়েছে, রাশিয়াতে দাবার প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে। দাবার যেসব ঘুঁটি বা ‘পিস’, তার নামকরণে তৎকালীন পারস্যের প্রভাব স্পষ্ট বলে কোনও-কোনও গবেষক মহলের দাবি। রাশিয়ায় ক্রমে দাবা এতখানি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, ঘরে-ঘরে দাবাড়ু তৈরি হতে থাকে।
সেখানকার শাসকরাও দাবা-অন্ত প্রাণ। সম্রাট ইভান ফোর নাকি দাবা খেলতে-খেলতে প্রয়াত হয়েছিলেন, এই দাবি করে কনস্তানতিন মাকোভস্কি-র অঁাকা একটি তৈলচিত্র, যদিও পরে এই ছবিটি চুরি হয়ে যায়। পিটার দ্য গ্রেট যেখানে যেতেন, সেখানেই নাকি দাবার ছক নিয়ে যেতেন, থাকত তঁার সঙ্গে খেলার সঙ্গীদল। দ্বিতীয় ক্যাথরিন দাবায় ডুবে থাকতেন অষ্টপ্রহর। সুইডেনের রাজা চতুর্থ গুস্তাফের সঙ্গে ১৭৯৬ সালে একক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন আর্ল স্ত্রোগানফ। সাহিত্যিক পুশকিনের দাবানুরাগ ছিল প্রবাদপ্রতিম। তঁার লাইব্রেরির শোভাবর্ধন করত এ. পেত্রভের বই: ‘দ্য গেম অফ চেস’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বটভনিকের নেতৃত্বে যেভাবে রুশ গ্র্যান্ডমাস্টারগণ বিশ্ব দাবার জগৎ শাসন করতে শুরু করেন, তা ছিল যেমন অভাবনীয়– তেমনই দুরূহ ছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলার দুঃসাহস।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দাবায় ৯ জন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের জন্ম দিয়েছে। রুশ গ্র্যান্ডমাস্টারদের একাধিপত্যে প্রথম ফাটল ধরান ববি ফিশার। ১৯৭২ সালে তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন মার্কিন দাবাড়ু রূপে। কিন্তু কারপভ এবং কাসপারভের সূত্রে পুনরায় শুরু হয় দাবায় রাশিয়ার একচেটিয়া প্রভাব। দাবাকে বরাবর রাশিয়া দেখে এসেছে বৌদ্ধিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হাতিয়ার রূপে। ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ ও তৎপরবর্তী সময়ে বিশ্বে রুশ-সম্ভ্রম বজায় রাখার আক্ষরিক অবলম্বন হয়ে উঠেছিল দাবা। নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘কুইন্স গ্যাম্বিট’ অনেকটা কাল্পনিক নির্মাণ হলেও তাতে প্রদর্শিত হয়েছে কী করে রাশিয়ার একচেটিয়া পাকড় বজায় ছিল বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লম্বা সময় ধরে।
কিন্তু ফিডে জুলাই মাসের যে-ক্রমতালিকা প্রকাশ করেছে ক্ল্যাসিকাল ফর্মাটের, তাতে দেখা যাচ্ছে প্রথম দশে রাশিয়ার কোনও গ্র্যান্ডমাস্টারই নেই! ইয়ান নেপোমনিয়াচি, যিনি দু’বার বিশ্বখেতাব জয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, তঁার র্যাঙ্ক এখন ১৪। বরং প্রথম দশে রয়েছেন আমেরিকার দু’জন এবং ভারতের তিনজন! পয়লা নম্বরে নরওয়ের ম্যাগনাস কার্লসেন, আর দশে নেদারল্যান্ডসের অনীশ গিরি। আজেরবাইজান, চিন ও ফ্রান্স থেকে রয়েছেন একজন করে। প্রশ্ন: তাহলে কি দাবায় রাশিয়ার আগের শ্রেষ্ঠত্ব আর নেই? একাধিপত্যের মুকুট এখন ভারতের দিকে ধাবমান? এই কৃতিত্ব কি বিশ্বনাথন আনন্দের প্রাপ্য?