- জয়ন্ত চক্রবর্তী
মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে অন্যান্য বছরের মতো এবারও মেধাতালিকায় উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে জায়গা করে নিতে দেখা গেল।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, একটা সময়ে উত্তরের ছাত্রছাত্রীদের সচরাচর মেধাতালিকায় দেখা যেত না। ছবিটা পালটাতে শুরু করে মোটামুটি এই শতকের প্রথম ভাগ থেকে। এর পেছনে রয়েছে অভিভাবক সহ ছাত্রছাত্রীদের সচেতনতা এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন দ্বারা নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ। একটা সময় পর্যন্ত নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগের ফলে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরের প্রান্তিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এবং শিক্ষকের গুণগত মানের ফারাক অনেকটাই ঘুচে যায়।
উত্তরের প্রান্তিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নতুন নতুন শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসায়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও খানিকটা পরিবর্তন ঘটে। যা শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠন অভিমুখী হতে এবং বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে আরও আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে। পাশাপাশি নতুন শিক্ষক আসায় বিশেষত গ্রামীণ স্কুলগুলোর সাংস্কৃতিক পরিবেশের উন্নতি ঘটে।
বিগত কয়েক বছরে মেধাতালিকায় আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। সেটি হল শহরকে ছাপিয়ে গ্রামীণ স্কুলের ছাত্রছাত্রীর মেধাতালিকায় উঠে আসা। স্কুল-শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষা বিস্তারের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি সদর্থক সূচক মনে হলেও, এমন ফলের পেছনে রয়েছে অন্য এক নিগূঢ় কারণ।
শহরাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিকাঠামোযুক্ত ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের প্রতি অনুরাগের কারণে বাংলামাধ্যম স্কুলগুলি ক্রমাগত মেধাহীনতার শিকার হচ্ছে। এই উপসর্গটি অনেকদিন আগেই কলকাতা এবং কলকাতার শহরতলির সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। যার ফলস্বরূপ, দীর্ঘদিন ধরেই মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক মেধাতালিকায় কলকাতার সরকারি স্কুলগুলো প্রায় ব্রাত্য। গ্রাম এলাকায় বেসরকারি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলগুলো এখনও শাখা বাড়ায়নি। তাই গ্রামের মেধাবী ছেলেমেয়েরা সরকারি স্কুলে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। তাই তো গ্রামীণ স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীদের মেধাতালিকায় এমন উত্তরণ।
সদ্য প্রকাশিত ফলাফলে উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অন্ধকার দিক কী? যে জেলাগুলি থেকে এক বা একাধিক ছাত্রছাত্রী মেধাতালিকায় জায়গা করে নিয়েছে, ঠিক সেই জেলাগুলি-ই সার্বিক পাশের হারে অনেকটা পিছিয়ে। এর নেপথ্যে রয়েছে অনেকগুলি আর্থসামাজিক এবং ভৌগোলিক কারণ। এর ফলে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকে।
প্রথমত, উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলার পাহাড় জঙ্গল ঘেরা প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থান। দ্বিতীয়ত, কৃষিকাজ নির্ভরতা এবং এক বড় অংশের মানুষের চা শ্রমিক হিসেবে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে জীবিকানির্বাহ। তৃতীয়ত, পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কখনও বাবা, কখনও মা, আবার কখনও উভয়েই বাইরে থাকায়, এক বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী অভিভাবকহীন হয়ে থাকে।
এমন অজস্র কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোভিডের পর থেকে মনস্তাত্ত্বিক কারণে এক বৃহৎ অংশের ছাত্রছাত্রীর স্কুলবিমুখতা। যদিও স্কুলের খাতায় বছরের পর বছর তাদের নাম থেকে যায়। হঠাৎ কখনও সামাজিক প্রকল্পের সুবিধা নিতে তারা স্কুলে এসে হাজির হয়, কিন্তু দৈনন্দিন পঠনপাঠনে তাদের তীব্র অনীহা। এভাবেই ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকা ছাত্রছাত্রীরা যখন মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিকের মতো বড় পরীক্ষার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়, আশানুরূপ ফলাফল করতে তারা ব্যর্থ হয়।
মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের ফল বলে দেয়, উত্তরবঙ্গে মেধা রয়েছে কিন্তু মেধা বিকাশে অন্তরায় পিছু ছাড়ছে না। এক বৃহৎ সংখ্যক ছাত্রছাত্রী উচ্চমাধ্যমিকে নব্বই শতাংশের ওপর নম্বর পেলেও সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষায় খুব সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। তার অন্যতম কারণ, মেট্রোপলিটান শহরগুলির মতো উত্তরবঙ্গে এই ধরনের পরীক্ষা প্রস্তুতির সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
সুযোগ নেই, যুগের চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আগামীদিনে বিভিন্ন পেশাগত বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের। স্কুল স্তরে নির্দিষ্ট পাঠক্রমের বাইরে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পেশাগত বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতেও শিক্ষকদের খুব একটা উদ্যোগী হতে দেখা যায় না। কিছু স্কুলে কারিগরি শিক্ষা পাঠক্রমটি চালু থাকলেও প্রশিক্ষকের অভাবে সেটি গুরুত্বহীন।
উত্তরবঙ্গের কিছু কলেজে ট্যুরিজম, মাস কমিউনিকেশন, লাইব্রেরি সায়েন্স, ডেটা সায়েন্স, বায়োটেকনলজি, কিংবা মাইক্রোবায়োলজির মতো আধুনিক বিষয়গুলি চালু। তবু যোগ্য প্রশিক্ষক এবং সঠিক পরিকাঠামোর অভাবে সেগুলো ধুঁকছে। এমতাবস্থায় উচ্চমাধ্যমিকে সাফল্যের পর অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ এই অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা সঠিক বিষয় নির্বাচন করে উচ্চশিক্ষায় গিয়ে এক বিশাল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। তাই মেধাতালিকায় সাফল্য পাওয়া উত্তরের কিছু কৃতী ছাত্রছাত্রীর উজ্জ্বল নামগুলো দেখে আমরা গর্বিত হলেও, কোথাও যেন আজও বেহাগের বিষণ্ণ সুর বাজে।
(লেখক দিনহাটার শিক্ষক)