সরষের মধ্যেই ভূত! দপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই পুরুলিয়ায় আদিবাসী জমি বেহাত

সরষের মধ্যেই ভূত! দপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই পুরুলিয়ায় আদিবাসী জমি বেহাত

ইন্ডিয়া খবর/INDIA
Spread the love


সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই ওরাং জনজাতির প্রায় ৯০ ডেসিমেল জমি সাধারণ সম্প্রদায় প্রোমোটারের হাতে চলে গিয়েছে বলে অভিযোগ। পুরুলিয়া পুর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটবাঁধ এলাকার বাসিন্দা পবিত্র কেড়িয়ার প্রায় ৯০ ডেসিমেল জমি পুরুলিয়া মফস্বল থানার ছড়রার বাসিন্দা বাপি বন্দোপাধ্যায়ের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছে। এই কাজে যুক্ত রয়েছে দুই প্রোমোটার সন্তোষ মুখোপাধ্যায় ও অরূপ বড়াল বলে অভিযোগ। এই মর্মে আদিবাসী পবিত্র কেড়িয়ারের ছেলে ক্লেমেন্ট কেড়িয়ার টামনা থানায় অভিযোগ করায় ওই দুই অভিযুক্তর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে তাদেরকে গ্রেফতার করেছে টামনা থানার পুলিশ। এছাড়া আরও একটি জমি সংক্রান্ত মামলায় ওই দুই অভিযুক্ত-সহ বাপি বন্দ্যোপাধ্যায়কেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অরূপ বড়াল বর্তমানে জেল হেফাজতে থাকলেও বাপি বন্দ্যোপাধ্যায় ও সন্তোষ মুখোপাধ্যায় পুলিশ হেফাজতেই রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

ধৃত সন্তোষের বাড়ি পুরুলিয়া শহরের রেনি রোড চুনাভাটি এলাকায়। অরূপ ভাটবাঁধের বাসিন্দা। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ” ওই ঘটনায় সুনির্দিষ্ট মামলা রুজুর পর তদন্ত চলছে। দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।” আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের প্রকল্প আধিকারিক তথা পুরুলিয়া মহকুমাশাসক (সদর ) উৎপলকুমার ঘোষ বলেন, “পুলিশ আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের এই বিষয়ে কোন অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কিনা। আমরা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছি ওই জমি সাধারণ সম্প্রদায়কে বিক্রি করার ক্ষেত্রে দপ্তরের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। আমরা আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।”

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ রয়েছে, কোনোভাবেই যাতে আদিবাসীদের জমি বেনিয়মের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষজনের হাতে না যায়। জঙ্গলমহলের জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকগুলি থেকে তাছাড়া সম্প্রতি ঝাড়গ্রামে বিশ্ব আদিবাসী দিবসেও তিনি এই কড়া বার্তা দেন। তাছাড়া ২০২১ সাল নাগাদ আদিবাসীদের জমি সংক্রান্ত বিষয়ে অযোধ্যা পাহাড়ে অশান্তির আবহও তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীকালে জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতির সামাল দেয়।

এছাড়া ২০২২ সালে জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী হুড়ার একটি জমি সংক্রান্ত বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়ে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরকে পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন। তার প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারও হয়। কিন্তু তারপরে আবার আদিবাসীদের জমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই কিভাবে সাধারণ সম্প্রদায়ের নামে রেজিস্ট্রি বা নিবন্ধন হয়ে গেল সেটাই বড় প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে ঝুলছে ? তাহলে কি সর্ষের মধ্যেই ভূত? এই ঘটনায় যিনি টামনা থানায় অভিযোগ করেন সেই ক্লেমেন্ট কেড়িয়ার বলেন, “২০১১-১২ সালে কোর্টের ডিগ্রি অনুযায়ী মৌজা ভাটবাঁধ, সোনাইজুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে মোট ৯৪.২৫ ডেসিমেল জমি ভাগ পাই। সেই সময় আমরা প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যে থাকায় ওই জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, অরূপ বড়াল এই দুই প্রোমোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদেরকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিই আমরা তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের। ফলে ওই সম্প্রদায়ের মানুষদেরকেই বিক্রি করতে হবে। তারা সেই সময় রাজি হলেও পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারি সাধারণ সম্প্রদায়ভুক্ত বাপি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করে বিক্রি করা হচ্ছে। ২০২৩ সাল থেকে আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করে আসছি। তারা আমাদের কথাবার্তাতে কোন সাড়া না দেওয়াতেই আমরা থানায় অভিযোগ জানাই।” ওই পরিবার জানিয়েছে, আদালতের ওই নির্দেশ অনুযায়ী ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের কাছে বহুবার তারা আবেদন করেছিলেন তাদের জমি রেকর্ডভুক্ত করার জন্য। কিন্তু তারা পরে জানতে পারেন তাদের জমির কোন রেকর্ড নেই।

কি বলছে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর? পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক তথা জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক রাজেশ রাঠোর বলেন, “এই বিষয়টি ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকের এক্তিয়ারভুক্ত।” পুরুলিয়া এক নম্বর ব্লকের ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক রুদ্ররূপ ভট্টাচার্য বলেন, “রেকর্ড আছে কিনা তা এখনই বলতে পারব না। আমাদের কাছে যা খবর আসে তাতে আদিবাসী জনজাতিদের জমি পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে আদিবাসী নয় এমন মানুষের মধ্যে কেনাবেচা হয়েছে। পুলিশ যা জানতে চেয়েছিল আমরা তা জানিয়েছি। এই ঘটনার একটি তদন্ত হচ্ছে।” কিন্তু প্রশ্ন গাফিলতি তাহলে কোথায়? যেখানে রেজিস্ট্রি হয়েছে সেখানেই কি কোথাও কোন বেনিয়ম? অতিরিক্ত জেলা নিবন্ধন আধিকারিক সন্দীপ পাল বলেন, “এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।”

তবে অবর জেলা নিবন্ধন আধিকারিক কৌশিক রায় বলেন, “পুলিশ আমাদের কাছে যা যা জানতে চেয়েছিল আমরা সেই তথ্য দিয়েছি। আমাদেরকে নতুন করে কিছু প্লট নম্বর দিয়েছে। এগুলো যাতে রেজিস্ট্রি না হয় তার জন্য। তাই আমরা ওই প্লট নম্বর দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কেন্দ্রীয়ভাবে লক করার জন্য। যাতে অন্য কোথাও রেজিস্ট্রি না হয়। এছাড়া রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত যে বেনিয়ম সামনে এসেছে তার বিধি অনুযায়ী আমরা তাদেরকে নোটিস করছি।” ওই দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, রেজিস্ট্রি হওয়া নথি ওই দপ্তর বাতিল করতে পারে না। তা বাতিল করতে পারে একমাত্র আদালত। তারা নোটিস দিয়ে আলোচনাক্রমে জমির আগের স্ট্যাটাসে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন এমন বিধি রয়েছে। ফলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আলোচনার ভিত্তিতে সেই পদক্ষেপের পথেই হাঁটছে জেলা নিবন্ধন কার্যালয়।

জমিস্বত্বের মামলা বা মালিকানার মামলা বিষয়ে ২০১১ সালে আদালতে (সিভিল) টাইটেল শুট হয়েছিল। তার ভিত্তিতে ২০১৬ সালে যে রায় হয় সেখানে পবিত্র কেড়িয়ার ও তার বোন সুপ্রিয়া কেড়িয়ার তাদের ভাগ অনুযায়ী ৯৪.২৫ ডেসিমেল করে জমি দেওয়া হয়। এর ভিত্তিতে ২০১৮ সালে পবিত্র কেড়িয়ারকে জমি চিহ্নিত করে জানিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ সেই জমি এই কেড়িয়ার পরিবার এবং অপরপক্ষ অর্থাৎ আদালতের নির্দেশে বাকি জমি যারা ভাগ পেয়েছিলেন তারা প্রোমোটার সন্তোষ মুখোপাধ্যায় ও অরূপ বড়ালের সঙ্গে জমি বিক্রির জন্য যোগাযোগ করলে তাদের ঘনিষ্ট বাপি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে অন্যজনের নামে রেজিস্ট্রি হয়ে যায় বলে অভিযোগ। গত ২২ শে জুলাই এই মর্মে অভিযোগ করেন ক্লেমেন্ট কেড়িয়ার। তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয় পুলিশ। তবে শুধু এই আদিবাসী পরিবারটির নয়। এই জেলায় নানা বেনিয়মে রীতিমতো জমি সংক্রান্তের মাফিয়ারাজ চলছে। বহু জমি এমন বেহাত হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *