সরকারি স্কুল মুছলে ডুববে বাংলা সংস্কৃতি

সরকারি স্কুল মুছলে ডুববে বাংলা সংস্কৃতি

ভিডিও/VIDEO
Spread the love


 

  • উমা মাজী মুখোপাধ্যায়

আমি সরকারি স্কুলেই পড়াশোনা করেছি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়- সবই সরকারপোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমাদের প্রজন্ম বা তৎপরবর্তী প্রজন্মও এই সরকারপোষিত বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে  পড়াশোনা করে বড় হয়েছেন, অনেক উচ্চ প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

আজ শুনতে পাচ্ছি, খবরের কাগজেও প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৮০০০ সরকারপোষিত বিদ্যালয় উঠে যাচ্ছে। অথচ বেসরকারি  ইংরেজিমাধ্যম স্কুল ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে যত্রতত্র!

সরকারপোষিত স্কুলে তো অনেক সুযোগসুবিধা। মিড-ডে মিল, স্কুল ড্রেস, জুতো, স্কুল ব্যাগ, সবুজসাথী সাইকেল, ফ্রি-তে মোবাইল (ক্লাস ইলেভেনে)| তারপর নানা স্কলারশিপ- শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রী, মেধাশ্রী, ওয়েসিস ইত্যাদি। তবু বিশেষত শহর লাগোয়া সরকারপোষিত স্কুলগুলি অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। গ্রামাঞ্চলে ছাত্র সংখ্যা কমছে, কিন্তু এখনও টিকে আছে।

রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে বলেছিলেন, ভারতবর্ষ দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত! এক ইংরেজি জানা লোকের ভারতবর্ষ আর ইংরেজি না জানা আপামর সাধারণ মানুষের ভারতবর্ষ। এখন এই পার্থক্য আরও প্রকট। ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে প্রশিক্ষিত ছাত্র আর সরকারপোষিত বাংলামাধ্যমে প্রশিক্ষিত ছাত্রছাত্রী।

আমার বাড়ির পাশেই একটি বিখ্যাত বাংলা মিডিয়াম সরকারপোষিত স্কুল। নেতাজির জন্মদিনে, ২৫ বৈশাখে, ১৫ অগাস্টে, ২৬ জানুয়ারিতে | তাঁরা প্রভাতফেরি বের করেন খুব জমজমাটভাবে। সকালটা কেমন নস্টালজিক হয়ে ওঠে ওই দিনগুলিতে।

কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আমাদের শিশুরা ওই দিনগুলির গুরুত্বই বোঝে না। বাংলার নবজাগরণের কোনও মনীষীদের তারা চেনে না – মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ডিরোজিও, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রফুল্লচন্দ্র রায় – না কাউকেই এরা তেমন চেনে না।

তবু ইংরেজিমাধ্যম বেসরকারি স্কুলগুলোতে এত ভিড়, টোটোচালক থেকে নিম্ন আয়ের মানুষও খুব কষ্ট করে তাঁদের ছেলেদের প্রাইভেট স্কুলে পড়ানোর দিকে ঝোঁক দেখাচ্ছেন। যাঁদের উপায় নেই, ‘দিন আনি দিন খাই’, তাঁদের ছেলেমেয়েদেরই একমাত্র সরকারপোষিত স্কুলগুলোতে পড়াচ্ছেন।

কিন্তু একদিন তো সরকারি বা সরকারপোষিত বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলি সর্বভারতীয় বোর্ডের সঙ্গে লড়েছে – কৃতী ছাত্রছাত্রী বের করেছে। সারা ভারতে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

তাহলে গোড়ায় গলদ কোথায়? আমি কয়েকজন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলছিলাম আমার চেনাজানা বৃত্তের মধ্যে। তাঁরা বললেন – মিড-ডে মিল, সাইকেল বিলি, আর স্কলারশিপ বণ্টনের মধ্যেই স্কুলে সময় কেটে যায়। শিক্ষকের সংখ্যা সীমিত। তাছাড়া চাপ নেই। অভিভাবক চাপ চান। এইট পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়াটা একটা মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে দেশীয় স্কুলগুলোতে।

আমাদের সময় পাশ-ফেল ছিল। বৃত্তি পরীক্ষা ছিল। ক্লাস টু থেকে ইংরেজি ছিল। শিক্ষকদের চাপ ছিল। শাসন ছিল। ক্লাসে হাতে চাবুক খাওয়ার ভয়ে হোমটাস্কগুলো করতাম। তখন ‘মিড-ডে মিল’ ছিল না। দুপুরে ১টায় টিফিন পিরিয়ডে খেতে যেতাম। হয়তো খোঁজ রাখতাম না, আমার পাশে বসা ছেলেটি বা মেয়েটি বাড়িতে গিয়ে খেতে পেল কি না।

মিড-ডে মিলের খুব দরকার। স্কুলে সাইকেল বা স্কলারশিপেরও খুব দরকার। কিন্তু আসল দরকার স্কুলের পড়াশোনার পরিবেশ!

এভাবে সরকারপোষিত স্কুলগুলো উঠে গেলে বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে।

(লেখক শিক্ষক শিলিগুড়ির বাসিন্দা)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *