শেখর বসু
শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটের সিঁড়িতে বসে আছি। বেলাশেষের আলো আরেকটু ম্লান হয়েছে। রাস্তার ওপর পড়ে থাকা স্কাইস্ক্র্যাপারের ছায়া বোধহয় এখন দীর্ঘতর। সামনের রাস্তার একধারে বসে দুটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে ড্রাম বাজাচ্ছিল। খেলনাগোছের ছোট ড্রাম। কিন্তু ওদের লম্বা লম্বা আঙুল নানা ধরনের বোল ফোটাচ্ছিল ওই ড্রামেই। উদ্দেশ্য, বাজনা শুনিয়ে পথচারীদের কাছ থেকে কিছু ডলার, সেন্ট রোজগার করা।
এখানে সরাসরি ভিক্ষা চাইতে খুব কম মানুষকেই দেখেছি। কেউ গান শোনায়, কেউ গিটার বাজায়, কেউ-বা ভায়োলিন। সামনে বিছানো কাপড়ের টুকরোয় বা খোলা টুপিতে পথচলতি মানুষের অনুগ্রহের দান জমা পড়ে। কিন্তু সামনের ওই পথের ওই দুজন ড্রাম বাজিয়ে রোজগারপত্তর করার সুযোগ পেল না এখন। একজন পুলিশ এসে ওদের তুলে দিয়েছিল।
আমি আবার ফিরে গিয়েছিলাম আমার পুরোনো চিন্তায়। অচেনা, অজানা শিকাগো শহরে তরুণ সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এ দেশের নিয়মকানুন একেবারেই আলাদা। সেপ্টেম্বরে ধর্মমহাসভা, কিন্তু জুলাই মাসেই সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল। বক্তাদের কে কবে বলবেন, কতক্ষণ ধরে বলবেন-সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে। মহাসভায় যোগদানের শেষ তারিখও পেরিয়ে গিয়েছে অনেক আগে।
হাতে সময় থাকলেই যে যোগদান করা যেত-তাও নয়। ধর্মসভায় অংশ নেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিচয়পত্র সঙ্গে থাকা দরকার। তরুণ সন্ন্যাসীর সঙ্গে তেমন কিছুই নেই।
ধনীর শহর শিকাগোতে খরচ লাগামছাড়া। বস্টনে গেলে খরচের মাত্রা একটু কমবে। সুতরাং একদিন রেলে চেপে বস্টনের পথে রওনা হয়ে গেলেন স্বামীজি। পথে এক বৃদ্ধার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। বৃদ্ধার নাম মিস ফেট স্যানবর্ন। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন স্বামীজিকে। এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বিবেকানন্দ।
ওখান থেকে তিনি মাদ্রাজের এক শিষ্যকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন-তোমরা যদি আরও কিছু টাকা পাঠিয়ে এখানে আমাকে ছ-মাস রাখার ব্যবস্থা করতে পারো, মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে।… আর যদি অত টাকা পাঠাতে না পারো, এ দেশ থেকে ফিরে যাওয়ার টাকাটা অন্তত পাঠিও। আমি ফিরেই যাব।
কিন্তু ভবিষ্যৎ-ইতিহাস বুঝি গতিপথ তখনই অন্যভাবে ঠিক করে ফেলেছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিক ভাষার বিশিষ্ট অধ্যাপক জেএইচ রাইটের সঙ্গে তরুণ এই ভারতীয় সন্ন্যাসীর পরিচয় হয়েছিল একদিন। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা গড়িয়েছিল ঘণ্টা চারেক ধরে। স্বামীজির অত্যাশ্চর্য জ্ঞান, বিদ্যার পরিধি ও প্রতিভার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন অধ্যাপক। তিনি বারবার একটিই অনুরোধ জানিয়েছিলেন তরুণ সন্ন্যাসীকে, আপনি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে ধর্মমহাসভায় যোগ দিন। আমেরিকান জাতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এটাই সেরা উপায়। স্বামীজি তখন নিজের অসুবিধের কথা খোলাখুলিভাবে অধ্যাপককে জানান। বলেছিলেন, আমাকে এখানে কেউ চেনে না, জানে না। আমি যে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি-এমন কোনও নিদর্শনও আমার কাছে নেই।
এ কথার উত্তরে রাইটসাহেব যা বলেছিলেন, সেই কথাটি বেশিরভাগ ভারতবাসী জানেন। চিরস্মরণীয় ওই উক্তিটি আরও একবার মনে করা যাক। অধ্যাপক রাইট বলেছিলেন, স্বামীজি, আপনার কাছে নিদর্শন চাওয়া আর সূর্যকে তার কিরণ দেওয়ার অধিকার কী জিজ্ঞেস করা-একই ব্যাপার।
ধর্মমহাসভায় স্বামীজি যাতে যোগ দিতে পারেন তার সব ব্যবস্থাই করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক রাইট। তারপর প্রতিনিধি নির্বাচন সভার সভাপতিকে ঐতিহাসিক সেই চিঠিটি লিখেছিলেন। চিঠির একটি লাইন আজও অনেকের মুখে মুখে ফেরে। সেটি হল, ইনি এমন একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি যে, আমাদের সব বিজ্ঞ অধ্যাপকের বিদ্যা একত্র করলেও এঁর বিদ্যার সমকক্ষ হয় না।
স্বামীজির কাছে টাকাপয়সা বিশেষ নেই বুঝতে পেরে তিনি শিকাগোর একটি টিকিট কেটে দিয়েছিলেন তাঁকে। শুধু তাই নয়, প্রাচ্য দেশের প্রতিনিধিদের থাকা ও খাওয়ার ভার যে কমিটির ওপর ছিল, তাঁদের নামেও একটি চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু সবকিছু তারপরেই মসৃণ হয়ে যায়নি। এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের প্রখ্যাত জীবনীকার প্রমথনাথ বসুর একটি লাইন উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, যেমন আলোক-প্রকাশের পূর্বে সময়ে সময়ে দিঙমণ্ডল নিবিড় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়, সেইরূপ জগতের সমক্ষে স্বামীজির বিশ্বব্যাপিনী প্রতিভা প্রকাশিত হইবার অব্যবহিত পূর্বে আরও কতকগুলি অসুবিধা, দুর্ঘটনা ও লাঞ্ছনা তাঁহাকে ভোগ করিতে হইয়াছিল।
এই অসুবিধে, দুর্ঘটনা ও লাঞ্ছনা খুব অল্প সময়ের মধ্যে নানান দিক থেকে এসেছিল। অনেকটা চড়া সুরের নাটকের মতো ক্রমাগত ঘাত-প্রতিঘাত। অধ্যাপক রাইট ধর্মমহাসভার যে ঠিকানাটি লিখে দিয়েছিলেন, সেটি হারিয়ে ফেলেছিলেন স্বামীজি। দুর্যোগের সেই শুরু। শিকাগো মস্তবড় শহর। যে যার কাজকর্মে ব্যস্ত। ধর্মমহাসভার ঠিকানা কেউ তাঁকে দিতে পারল না। শহরের এই উত্তর-পূর্বদিকে বেশিরভাগ বাসিন্দাই জার্মান। ইংরেজিটা তাদের খুব ভালো আসে না। সুতরাং ভিনদেশি এই মানুষটিকে বোঝা বা বোঝানো তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছিল। একটা হোটেলের সন্ধানও কেউ দিতে পারেনি।
নিরুপায় হয়ে স্বামীজি রেলের মালগাড়ি রাখার এলাকায় একটা খালি বাক্সের মধ্যে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন কোনও মতে। কিন্তু সকালেও সমস্যার কোনও সুরাহা হল না। ধর্মমহাসভার ঠিকানা কেউ বলতে পারল না। এদিকে মানুষটি খিদে-তেষ্টায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন। লেকের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। পাশে সুরম্য বাড়িঘর। ভারতবর্ষের এক সন্ন্যাসীর পক্ষে ভিক্ষে চাওয়াটা খুব সহজ কাজ। দেশের মাটিতে যাঁরা ভিক্ষা দেন তাঁরা শ্রদ্ধার সঙ্গে দেন। কিন্তু সুদূর আমেরিকায় ওই নিয়মটা খাটে না। ওখানে ভিক্ষে চাইতে গিয়ে তাঁর লাঞ্ছনার মাত্রা আরও বেড়েছিল।
শেষের দিকে দুটি মাত্র কথা ছিল স্বামীজির মুখে। হয় ধর্মমহাসভার ঠিকানা বলো, নয় ভিক্ষা দাও। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি তাতে।
শেষে অবসন্ন স্বামীজি পথের ধারে বসে পড়েছিলেন। এমন সময় সামনের অট্টালিকা থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন-আপনি কি ধর্মমহাসভার প্রতিনিধি?
জবাবে স্বামীজি জানালেন, হ্যাঁ, কিন্তু সভার কার্যালয়ের ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি।
মহিলা বললেন, আপনি আসুন আমার সঙ্গে।
বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তিনি স্বামীজির খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করলেন, তারপর ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ধর্মমহাসভার অফিসে। পরিচয়পত্র দেখানোর পরে মহাসভার প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন স্বামীজি। তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল প্রাচ্যদেশের অন্যান্য প্রতিনিধির সঙ্গে।
ওই যে মার্কিন মহিলা স্বামীজির সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন সেদিন, তাঁর নাম মিসেস হেল। তিনি শিকাগোর একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি জর্জ ডব্লিউ হেলের স্ত্রী। এই পরিবারটির সঙ্গে স্বামীজির হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দ্রুত।
সেদিনের ওইসব ঘটনার উল্লেখ করে স্বামীজি পরে জানিয়েছিলেন, সেদিন তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল-প্রভু অনুক্ষণ সঙ্গে থেকে তাঁকে রক্ষা করে যাচ্ছেন।
শুনেছিলাম, ইতিহাসের পাতা কখনো-কখনো জীবন্ত হয়ে ওঠে। শোনা কথাটা আমার জীবনে সত্যি হয়ে উঠেছিল শিকাগোর ওই আর্ট ইনস্টিটিউটের সিঁড়িতে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে। কী এক অলৌকিক উপায়ে প্রায় দেড়শো বছর আগেকার শিকাগো শহরের কিছু দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। আরও কিছুক্ষণ ওখানে বসে থাকার পরে উঠে পড়েছিলাম। দিনের আলো আরও একটু বুঝি ম্লান হয়েছিল, কিন্তু বিদ্যুতের জোরালো আলো সেই ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছিল পুরোপুরি।
ঝলমলে আলোয় এমন একটা শহরে হাঁটার মজাই আলাদা। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম মিশিগান হ্রদের ধারে। নামেই হ্রদ, চেহারা অবিকল সমুদ্রের মতো। অঙ্কের হিসেবে লেক মিশিগান লম্বায় প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার, চওড়ায় প্রায় দুশো কিলোমিটার। কুলকিনারাহীন এই জলরাশির সঙ্গে সমুদ্রের কোনও তফাত নেই। হ্রদের বেশ খানিকটা জায়গা ভরে আছে বাহারি সব জলযানে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে অসংখ্য নৌকো, জাহাজ চলে এখানে। ভ্রমণের জন্য আছে নানারকম ক্রুজের ব্যবস্থা। কিন্তু সে তো পরের ব্যাপার। হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে বিপুল জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকলেই সারা শরীরে রোমাঞ্চ খেলে যায়।
লেক মিশিগান আমেরিকার চারটি রাজ্যকে ছুঁয়ে রেখেছে, কিন্তু হ্রদ-তীরবর্তী বৃহত্তম শহর এই শিকাগো। খানিকটা গোল হয়ে ঘুরে গিয়েছে হ্রদ। পাড়ে দাঁড়ালে স্কাইস্ক্র্যাপারে মোড়া শহরের অসামান্য দৃশ্য দেখা যায়। সন্ধের আবছা অন্ধকারে আলোয় ঝলমল করছিল ওই বহুতলগুলি। আলোর প্রতিফলন হ্রদের বুকে। ওখানে ভেসে থাকা অপরূপ সব নৌকোর আলো জল এবং আকাশকে বুঝি আরও মায়াময় করে তুলেছিল।
লেকের ধারের চওড়া পথটি বেশ পরিচ্ছন্ন। যথেষ্ট চওড়া কংক্রিটের পথ। একধারে গাছের সারি। লেকফ্রন্ট-বরাবর পথটি চলে গেছে মাইল কুড়ি। পথে মাঝে মাঝেই ওয়াকার, জগার আর স্কেটারদের দেখা মিলছিল। স্বাস্থ্যসচেতন মার্কিনিরা এমন সুন্দর একটি পথকে যে স্বাস্থ্যচর্চার কাজে লাগাবেন-তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকতা নেই।
লেকের ধারে বেশ কিছুক্ষণ ধরে হেঁটেছি। মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে তাকাচ্ছিলাম লেকের দিকে। আগের দৃশ্যের সঙ্গে পরের দৃশ্যের একটু বুঝি তফাত তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু দুটোই সমান উপভোগ্য। লেকের পাশে দাঁড়িয়ে শহরটাকেও বেশ লাগছিল। একদিকে শুধুই প্রকৃতি অন্যদিকে মানুষের তৈরি স্থাপত্য। সেতুবন্ধনের কাজটির মধ্যেও বুঝি জাদুর ছোঁয়া ছিল। শহর ও প্রকৃতি মিলেমিশে আছে চমৎকার।
দিনের আলো মুছে গেছে একদম। আকাশে জ্বলজ্বলে তারা। দূষণ বন্ধ করার নানান ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে গোটা মার্কিন মুলুকে। আইন প্রয়োগে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য নেই কোথাও। নাগরিকরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় সর্বত্র, তার ফলে কোনও রকমের দূষণই চোখে পড়ে না কোথাও। পথঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
হোটেলের বিছানায় শোওয়ার আগে টিভি চালিয়ে দিয়েছিলাম। স্থানীয় সংবাদ হচ্ছিল। দেখলাম, গণতান্ত্রিক দেশের একজন লোক টেবিলের ওপর ঘুসি মারতে মারতে এক সর্বোচ্চ নেতার নাম নিয়ে বলছে, ইউ কানট বি লিংকন।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখানে অঢেল। খোদ প্রেসিডেন্টকেও যে কেউ দু’কথা শুনিয়ে দিতে পারে। জ্বালাময়ী ওই ভাষণটি কিছুক্ষণ শোনার পরে টিভি বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলাম।