সন্ত্রাস আবহে শান্তির নয়, যুদ্ধেরই বাজার

সন্ত্রাস আবহে শান্তির নয়, যুদ্ধেরই বাজার

ব্লগ/BLOG
Spread the love


শেখর সাহা

“বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের নেপথ্যে অস্ত্র ব্যবসার খেলা, শান্তির বাজার নেই, যুদ্ধের বহু বিক্রেতা আছে।”

আজকের বিশ্বে ধর্মীয় উগ্রতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং যুদ্ধ যেন পরস্পরের সহযাত্রী হয়ে উঠেছে। এগুলোর পেছনে কাজ করছে একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চক্র—যার উদ্দেশ্য ক্ষমতা, প্রভাব ও অর্থলাভ। সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী করাই তাদের মূল কৌশল।

রাষ্ট্রসংঘের (২০২৩) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালে প্রায় ৩০,০০০ তরুণ আইএসে যোগ দিয়েছে, যাদের অধিকাংশই দারিদ্র্যপীড়িত ও দিশাহীন পরিবেশ থেকে। এদের ধর্মীয় উন্মাদনায় জড়িয়ে মগজধোলাই করা হয়। সত্যজিৎ রায়ের “হীরক রাজার দেশে” চলচ্চিত্রের মতোই, যেখানে চিন্তাশীল মানুষ পরিণত হন অন্ধ অনুসারীতে। এই তরুণদেরও তৈরি করা হয় ‘যোদ্ধা’ হিসেবে। কিন্তু এই যোদ্ধারা অস্ত্র হাতে নিলে হারিয়ে ফেলে মানবিকতা।

এই প্রক্রিয়ায় মূল লক্ষ্যবস্তু হয় সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির তরুণরা-যাদের ধর্মের নামে, পরিচয়ের নামে বিভ্রান্ত করে কাজে লাগানো হয় রাজনৈতিক খেলার অংশ হিসেবে। অথচ যারা এই সন্ত্রাসী কাঠামো সৃষ্টি করে, অর্থায়ন করে ও পরিচালনা করে, তারা থাকে নিরাপদ আশ্রয়ে।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অস্ত্রবাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, ফ্রান্স ও জার্মানি মিলে ৭৫%-এরও বেশি অস্ত্র রপ্তানি করে। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হয়, অস্ত্রের চাহিদা তত বাড়ে এবং বাড়ে মুনাফা।

এটা একটা অমোঘ বাস্তবতা : যত বেশি সংঘাত, তত বেশি লাভ এই মুষ্টিমেয় উৎপাদকের। তারা চায় সংঘাত চলুক, যুদ্ধ থামবে না-এই নীতিতেই টিকে থাকে অস্ত্র বাজার।

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ রেডক্রস-এর তথ্য অনুসারে, আধুনিক যুদ্ধ ও সন্ত্রাসে নিহতদের ৯০ শতাংশই সাধারণ নিরীহ নাগরিক। পালটা হামলায় প্রাণ হারান বহু সেনাসদস্য, যাঁরা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। অথচ যারা সংঘাতের সিদ্ধান্ত নেয়—তারা কখনোই যুদ্ধক্ষেত্রে থাকে না।

ভারতের ইতিহাসেও সন্ত্রাসবাদের নির্মম প্রভাব স্পষ্ট। ইন্দিরা ও রাজীব হত্যা তার প্রমাণ।

সন্ত্রাসের পেছনে প্রকৃত ধর্ম নয়, বরং ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপব্যবহারই মূল চালিকাশক্তি। কিছু সাম্প্রতিক উদাহরণ : ১) মধ্যপ্রাচ্যে, তালিবান নারীদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে ধর্মের নামে। ২) মায়ানমারে, রোহিঙ্গাদের নিধনে ধর্মীয় উসকানিকে হাতিয়ার করা হয়েছে। ৩) ভারতে, সম্প্রতি ধর্মীয় বিভাজনের ফলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বেড়েছে।

এই উত্তেজনা সৃষ্টি করে সমাজে ঘৃণা, অনিশ্চয়তা ও বিভাজনের বাতাবরণ। এই বৈশ্বিক সংঘাত ও সন্ত্রাসচক্র থেকে উপকৃত মূল তিনটি পক্ষ । ১) অস্ত্র প্রস্তুতকারী কর্পোরেশনগুলো। যুদ্ধ চলাকালীন বিপুল পরিমাণে অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে। ২) উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ও নেতা– সহজলভ্য জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে। ৩) রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীরা। ভোটের আগে ‘সন্ত্রাস’ ও ‘জাতীয় নিরাপত্তা’কে ইস্যু করে জনমত প্রভাবিত করে।

এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন বহুমাত্রিক উদ্যোগ। ১) মানবিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বিস্তার, যাতে যুক্তিবোধ ও সহনশীলতা গড়ে ওঠে। ২) তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, যাতে তারা বিভ্রান্তির শিকার না হয়। ৩) মগজধোলাই রোধে সচেতনতা কর্মসূচি ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক প্রচারমাধ্যমের প্রসার।

বিশ্ব যদি সত্যিই শান্তি চায়, তবে অস্ত্র নয়, বিনিয়োগ করতে হবে মানুষের উন্নয়নে। শান্তি তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন যুদ্ধ আর পণ্য হয়ে উঠবে না।

(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *