- বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি
দাঁড়িয়ে আছি নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের জন লেনন মেমোরিয়াল স্ট্রবেরি ফিল্ডসে, সাদাকালো পাথরে মোজাইকের মাঝখানে লেখা ‘Think about’। গায়ক, দার্শনিক লেনন-এর পাশেই ডাকোটা হাউসের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন, সংগীতের সাধনায় ডুবে থাকা শিল্পীকে বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করেন তাঁরই এক ভক্ত মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান, লেনন নাকি যিশুর থেকেও বেশি জনপ্রিয়! এখানে সারা পৃথিবীর মানুষ আসেন শ্রদ্ধা জানাতে, আমাদের মতো বিটলস ভক্তদের চোখ জলে ভরে যায়।
গতকাল এসেছি বারলিংটন থেকে। এবারে আমেরিকা ভ্রমণটা সংস্কৃতির খোঁজে। সারা পৃথিবীর শিল্প-সংস্কৃতির মিলনস্থল এ দেশ। মার্কিন মুলুক মানেই যে শুধু সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদ নয়, এ দেশ মার্ক টোয়েনের,আর্নেস্ট হেমিংওয়েরও, এখানেই জন্মেছেন এলভিস প্রিসলি, মাইকেল জ্যাকসন, বব ডিলান… এসবের খোঁজেই এসেছি। হোটেলে পৌঁছেই গেলাম পাশের চিনা রেস্তোরাঁয়, সেখানে খাবার পরিবেশন করছেন যিনি তাঁর বাড়ি আবার পেরুতে!
আজ বিকেলে যাব ব্রডওয়ে মিউজিক্যাল দেখতে… মাইকেল জ্যাকসন শো। আগের বছর এসে মুগ্ধ হয়েছিলাম ‘আলাদিন’ দেখে… সে এক স্বপ্নের মতো অভিজ্ঞতা!
ছোটবেলার সংগ্রামের দিন পেরিয়ে মাইকেল জ্যাকসনের ‘কিং অফ পপ’ হয়ে ওঠার উড়ান, তাঁর জীবনকাহিনী নিয়ে তৈরি এই মিউজিক্যাল শো দেখে আপ্লুত হয়ে যাই, মুনওয়াকে চেপে চলে যাই কল্পনার জগতে, ‘উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড উই আর দ্য চিলড্রেন’, ‘বিট ইট’, ‘ব্যাড’, ‘বিলি জিন’, ‘ম্যান ইন দ্য মিরর’, ‘স্মুথ ক্রিমিনাল’… একের পর এক গান মনের পানসিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তারুণ্যের উচ্ছল দিনগুলোয়; স্বপ্নাহতের মতো ম্যানহাটানের রাস্তা ধরে হেঁটে বেড়াই, আমার গলায় মাইকেল জ্যাকসন, মেয়েও গুনগুন করে চলেছে পপসম্রাটের সুর, সংগীতের এই চিরকালীন সফর মুছে দেয় কালের গণ্ডি, দেশের সীমা।
বেশ রাত হয়েছে, হোটেলের সামনেই আইসক্রিমের গাড়ি, লোভ সামলাতে না পেরে কিনেই ফেলি, মনে পড়ে কলেজে পড়ার সময় প্রায় মধ্যরাতে ধর্মতলা থেকে আইসক্রিম খেতে খেতে হেঁটে শিয়ালদার কলেজে হস্টেলে ফেরার কথা। একটু দূরে টাইমস স্কোয়ার ঝলমল করে, গুলজার সাহেবের কলমে ভর করে ‘রাত চুপচাপ দবে পাও চলে আতে হ্যায়, রাত খামোশ হ্যায় রোতি নহি হসতি ভি নহি’।
আজকের সকালটা ভীষণই সুন্দর, হালকা রোদ, ঠান্ডা হাওয়া, বসে আছি বিখ্যাত আমেরিকান রেস্তোরাঁ জুনিয়রসে, প্রাতরাশে অর্ডার দিয়েছি এগ বেনেডিক্ট; ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিউ ইয়র্ক থেকেই এই বিখ্যাত খাবারটির যাত্রা শুরু; ডিমের পোচ, মাংসের টুকরোর ওপরে ইংলিশ মাফিন, বেকন… সবকিছুর ওপরে ডিমের কুসুম, মাখন আর লেবুর রস দিয়ে তৈরি হল্যান্ডেস সস… পরম উপাদেয় বললেও কিছুই বলা হয় না! রেস্তোরাঁজুড়ে নানা দেশের মানুষের মেলা বসে গিয়েছে, কর্মীরাও বিভিন্ন দেশের, দেখলে বোঝাই যায় না বিশ্বজুড়ে এত বিভেদ, যুদ্ধ।
ব্রডওয়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি, সামনেই বিখ্যাত রেডিও সিটি মিউজিক হল, ১৯৩২ সালে আর্ট ডেকো স্টাইলে তৈরি এই প্রেক্ষাগৃহ সাক্ষী কত বিখ্যাত শোয়ের! পেরিয়ে আসি উইন্টার গার্ডেন থিয়েটার, সেখানে এখন চলছে প্রবাদপ্রতিম সুইডিশ ব্যান্ড ABBA-এর গান নিয়ে তৈরি মিউজিক্যাল শো ‘Mamma Miya’, শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের দিনগুলো ফিরে ফিরে আসে… তখন ইন্টারনেট ছিল না, রেকর্ড আর ক্যাসেটের রোমান্টিকতায় ভেসে যেতাম সাগরপাড়ের দেশে, আজ সেসব চোখের সামনে, ভালোলাগায় মন ভরে যায়।
কয়েক পা এগোলেই সেন্ট্রাল পার্ক। ৮৪৩ একরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই সুবিশাল পার্ক ডিজাইন করেন ল্যান্ডস্কেপ স্থপতি ফ্রেডরিক ল’ ওলমস্টেড এবং ক্যালভার্ট ভক্স। ১৮৫৭ সালে পথ চলা শুরু এই নাগরিক মরুদ্যানের। হোম অ্যালোন ২, স্টুয়ার্ট লিটল সহ অসংখ্য হলিউড সিনেমার শুটিং হয়েছে এখানে, ‘কাল হো না হো’ ছবিতে শাহরুখ খান এই পার্কেই গান গেয়ে বেড়ান! ফোয়ারা, লেক, চিড়িয়াখানা দিয়ে সাজানো এই সবুজের সমারোহে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাহিত্যসভা। এখানেই রয়েছে জন লেনন মেমোরিয়াল, যেখান থেকে আমার এই লেখার শুরু। ভেতরে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ, প্রশস্ত রাস্তার দখল নিয়েছেন সাইক্লিস্ট আর হেঁটে চলা মানুষজন, তাঁদের সচকিত করে পাশ দিয়ে পর্যটকদের নিয়ে হেলতে-দুলতে চলেছে ঘোড়ার গাড়ি আর সাইকেল রিকশা। আমরাও এক্কাগাড়িতে চেপে পুরো পার্ক বেড়িয়ে আসি। গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে আকাশছোঁয়া টাওয়ার, কোটি কোটি ডলার মূল্যের এই প্রাসাদে শিল্পের একটু জায়গা হয় কিনা তাই ভাবি!
একটু ক্লান্ত লাগছে, সামনেই স্টারবাকস, এক কাপ ক্যাপুচিনো নিয়ে জিরিয়ে নিই। গতবার এসে মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম দেখেছি, এবার দেখব মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট…MoMA। এখানেই রয়েছে বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত কিউবিস্ট আর্টের নিদর্শন; পাবলো পিকাসো ও জর্জ ব্রাকের হাতে প্যারিসে শুরু হয়ে এই যুগান্তকারী শিল্প সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে; সাগর পেরিয়ে স্থান নেয় MoMA-এর গ্যালারিতেও।
মিউজিয়ামের পরিবেশটাই মডার্ন; স্থাপত্য, গ্যালারির বিন্যাস সবই অন্যরকম। অবাক হয়ে দেখি ভিনসেন্ট ভ্যান গগের কালজয়ী পেন্টিং ‘স্টারি নাইট’, মনে পড়ে প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামের কথা, সেখানে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর শিল্পসৃষ্টির সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি; আজ নিউইয়র্ক মিশে যায় প্যারিসের সঙ্গে; মহাবিশ্বের উঠোনে বসে মাইকেল জ্যাকসন, ভ্যান গগ, দা ভিঞ্চি সুর, তাল, রং নিয়ে গল্প করেন… আমাদের জীবনানন্দ দাশ ধানসিঁড়ির তীরে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন, এনারাও কি আবার ফিরে আসবেন হাডসন অথবা সেন নদীর ধারে?
বেলা পড়ে আসে, আলো কমে আসে, শিল্পাঙ্গন ছেড়ে চলি অর্থনীতির হাইওয়ে ওয়াল স্ট্রিটের দিকে, আমার অপেক্ষায় রয়েছে আইকনিক ব্রোঞ্জ স্থাপত্য চার্জিং বুল, এখানে ধনতন্ত্র শিং উঁচিয়ে এগিয়ে (পিছিয়ে যাচ্ছে না তো?) চলেছে এক অলীক স্বপ্নের দিকে।
পায়ে হেঁটে একটু এগোতেই হাডসন, গুরনাম সিংজির ট্যাক্সিতে উঠে একটু যেতেই চোখে পড়ে ব্রুকলিন ব্রিজ, মরচে রঙের এই বিখ্যাত ব্রিজ পেরোলেই অন্য আরেক নিউইয়র্ক… ঝলমলে আলো এখানে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় না, নরম আবেশে ছড়িয়ে পড়ে নদীর জলে; ম্যানহাটন ব্রিজ পেরিয়ে ঝমঝম শব্দে ট্রেন চলে যায়, দূরে জ্বলজ্বল করে উইলিয়ামসবার্গ ব্রিজের আলো, নদীর ওপারে সন্ধ্যার আকাশে জেগে থাকে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। জলের ধারের অভিজাত ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় বসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি, ‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো, গোধূলির রঙে হবে এ ধরণী স্বপ্নের দেশ তো!’
চমক ভাঙে পরিবেশনকারীর ডাকে… ‘ইওর গ্রিলড অক্টোপাস অ্যান্ড রিভিওলি পাস্তা স্যর, এনজয়!’ মার্কিন দেশে বসে খাঁটি ইতালিয়ান ডেলিকেসিতে মন দিই। আগামীকাল সকালেই বাড়ি ফেরার ফ্লাইট।