ধীর পদক্ষেপ এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে একশো বছর পার করে ফেলল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। ভারতের রাজনীতিতে শতাব্দীপ্রাচীন সংগঠন বলতে প্রথমে উঠে আসে কংগ্রেসের নাম। সিপিআইয়ের বয়সও ১০০ পেরিয়েছে। এবার সেই তালিকায় এল আরএসএস-ও। একশো বছর ধরে নিজেদের মতাদর্শ অনুযায়ী এগিয়ে চলা কম কথা নয়। ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলা নিঃসন্দেহে বড় সাফল্য।
বাম, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি অবশ্য সংঘের যাত্রাপথকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। বরং সংঘের হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিতভাবেই সোচ্চার তারা। নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বিজেপির তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা এখন সংঘের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আরএসএসের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ স্মারক-মুদ্রার উদ্বোধন করেছেন মোদি। ঘটনাচক্রে এবার আরএসএসের শতবর্ষপূর্তি এবং জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির জন্মজয়ন্তী একইদিনে পড়েছে।
কংগ্রেস ও তার সহযোগীরা মনে করে, আরএসএস হল সেই বিচারধারা, যা গান্ধিজিকে হত্যা করেছিল। অপরপক্ষ অবশ্য আরএসএস-কে ত্যাগ ও সেবার প্রতীক হিসেবে গণ্য করে। কংগ্রেস ও বামেরা চিরকাল আরএসএসের বিরোধী। যদিও সিপিএম জরুরি অবস্থার সময় গেরুয়া শিবিরের সুরে সুর মিলিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল। রাজীব গান্ধিকে ক্ষমতাচ্যুত করতেও বিজেপির হাত ধরেছিল সিপিএম।
তবে ইদানীং বিজেপির পাশাপাশি আরএসএসের সমালোচনাতেও সরব সিপিএম। রাহুল গান্ধি গত ১১ বছর ধরে চড়া সুরে আরএসএসের বিরোধিতা করছেন লাগাতারভাবে। আরএসএস-বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটের লড়াইকে তিনি গত ১১ বছর ধরে দুই বিচারধারার লড়াই বলে চলেছেন।
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আরএসএসের একের পর এক অ্যাজেন্ডা পূরণ করার ব্রত পালন চলছে। দেশের শাসনব্যবস্থায় সংঘের হিন্দুত্ববাদী ভাবনার প্রভাব এখন ব্যাপক। জওহরলাল নেহরুর ভাবনার সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের ব্যবস্থাকে ভেঙে হিন্দুত্ববাদী সমাজ গড়ে তুলতে আরএসএস দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে পরিশ্রম করেছে। সেই পরিশ্রমের ফল এতদিনে চাক্ষুষ করা যাচ্ছে।
শুধু শাসনব্যবস্থায় নয়, দেশের রাজনীতিতেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে চাপের মুখে ঠেলে দিতে পেরেছে আরএসএস। হিন্দুত্ববাদী ভাবনা বর্তমানে দেশের দলনির্বিশেষে রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। বিজেপি-আরএসএসের পাশাপাশি হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে বিরোধী দলগুলি ঘটা করে মন্দিরের উদ্বোধন করছে, পূজার্চনা করছে, নেতারা কপালে তিলক কাটছেন। সর্বধর্মসমন্বয়ের কথা বলেও বিরোধীরা ধর্মীয় উত্সবে জড়িয়ে পড়ছে।
সংবিধানে দেশের মূল কাঠামো ধর্মনিরপেক্ষতা বলে লেখা থাকলেও যেভাবে ধর্মকে রাজনীতির অন্যতম বড় অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা চলছে, ধর্মকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি যেভাবে আবর্তিত হচ্ছে, তা আরএসএস ও তাদের মতাদর্শের নিঃসন্দেহে বড় সাফল্য। কংগ্রেস একদা দেশের সবথেকে বড় রাজনৈতিক শক্তি ছিল। ভোটে জিততে সেই কংগ্রেসের মূল শক্তি নেহরু-গান্ধি পরিবারের সদস্যদের এখন দিনের পর দিন পদযাত্রা করতে হচ্ছে।
আরএসএস যে অনেক প্রতিকূলতাকে জয় করে ১০০ বছরের গণ্ডি পেরিয়েছে, সেটা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত না থাকা, গান্ধিজিকে হত্যার চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত থাকা ইত্যাদি অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে থাকা সত্ত্বেও দেশে আরএসএসের শাখা বাড়ছে, দলে দলে মানুষ সংঘের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। হতে পারে সেটা হিন্দুত্ব, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের জোয়ারের কারণে।
যে কারণই হোক, শতবর্ষ পেরিয়ে আরএসএস দেশের রাজনীতিতে বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। অথচ ১৯২৫ সালে আরএসএসের সঙ্গে যাত্রা শুরু করলেও শতবর্ষ পরে সিপিআইকে দেশে শুধু দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হয়। দেশে মার্কসবাদ, কমিউনিজম, সমাজতন্ত্রের চর্চাও ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, আরএসএস বহালতবিয়তে শক্তি বাড়াচ্ছে। আরএসএস-কে তাই শুধু গালমন্দ করে লাভ নেই, অন্য মতাদর্শটির কেন এমন দশা হল, তার উত্তর খুঁজে বের করা সংঘের সমালোচকদের কর্তব্য।