বর্ষাকালীন অধিবেশনের প্রথম সপ্তাহটা বিদেশেই থাকছেন প্রধানমন্ত্রী। ‘ব্রুট মেজরিটি’ সংসদের গরিমা ও সংসদীয় রীতিনীতি শিকেয় তুলেছে। প্রধানমন্ত্রীকেও করে তুলেছে ‘নির্বিকার যথেচ্ছাচারী’। তাই তিনি অধিবেশনে না-থাকার স্পর্ধা দেখাতেই পারেন। ১১ বছর ধরে সংসদে এমনটাই দস্তুর। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
সংসদের আরও একটা অধিবেশন শুরু হল, শেষও হবে যথারীতি। কিন্তু শুরুর চমক, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়ের অপ্রত্যাশিত পদত্যাগের খবর, জন্ম দিল অনেক ধরনের রাজনৈতিক জল্পনার। ৭৪ বছর বয়সে কেন ইস্তফা, কোন ক্ষোভে, স্বাস্থ্যের অজুহাত কতটা গ্রহণযোগ্য, তঁাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হল কি না, না অন্য কোনও কারণ– এসব প্রশ্ন দপদপ করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। যে-নেতারা দলের সভাপতি বাছতে হিমশিম খাচ্ছেন, তঁারা নতুন উপ-রাষ্ট্রপতি কীভাবে বাছবেন, কাকে বাছবেন, সোমবার রাত থেকেই সেই আলোচনায় রাজনীতি সরগরম। বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিরোধীরা সরকার পক্ষকে কতটা চাপে ফেলতে পারবে, সেই জল্পনা হুট করে স্তিমিত। যদিও সাময়িকভাবে।
তবে, অতীত অভিজ্ঞতার আলোয় বলা যেতে পারে, এই অধিবেশনও বিরোধীদের হাহুতাশের অবসান ঘটাতে পারবে না। লোকসভার স্পিকার ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এত দিন বিরোধীদের ধমকে গিয়েছেন। উপ-রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের কারণে রাজ্যসভার সদস্যরা হয়তো কিছুটা স্বস্তিতে থাকবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায়, সরকারি ইশারায় ডেপুটি চেয়ারম্যানও কোনও ন্যায্য দাবি মানবেন না। ১১ বছরে একবারও মুলতবি প্রস্তাব মানা হয়নি। এবারেও হবে না। হুট বলতে বিরোধী বক্তব্যও কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হবে। যে-বিল সরকার যেভাবে পাস করাতে চায়, সেভাবেই এবারও পাস হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও কেউ জবাবদিহিতে বাধ্য করাতে পারবেন না। যঁারা মনে করছেন, এটা-ওটা নিয়ে তঁাকে কোণঠাসা করবেন, তঁাদের বিফল মনোরথ হতে হবে। ১১ বছরে সংসদে একটি প্রশ্নেরও উত্তর তিনি দেননি, এবার দেবেন তেমন আশা বাড়াবাড়ি হবে। সংসদের ছবি এবারও অপরিবর্তিত থাকবে।
আজ বুধবার, অধিবেশনের তৃতীয় দিনেই, দু’দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী বিলেত যাচ্ছেন। সেখান থেকে মালদ্বীপ যাবেন আরও দু’দিনের জন্য। তার মানে, প্রথম সপ্তাহেই তিনি ফুড়ুৎ। অথচ অতীতে প্রধানমন্ত্রীরা নেহাত অপারগ না হলে অধিবেশন চলাকালীন বিদেশে যেতেন না। তঁারা প্রতিদিন সংসদে আসতেন। নির্দিষ্ট দু’দিন দুই কক্ষে উপস্থিত থাকতেন। প্রশ্নের জবাব দিতেন। সংসদকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ব্যতিক্রমী। তিন-চারদিনের বেশি হাউসে হাজির থাকার প্রয়োজন অনুভব করেননি। এবারও করবেন না। অথচ প্রচার, তিনি গণতন্ত্রের ধারক, বাহক, পূজারি! সংসদ ভবনে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন সিঁড়িতে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম সেরে। গণতন্ত্রের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল নন, এই অপবাদ দিলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে হাজতবাস হতে পারে।
প্রতিটি অধিবেশনের আগেই বিরোধীরা কোমর কষে– সরকারকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনা ছকে। কিন্তু ওই পর্যন্ত। ‘ব্রুট মেজরিটি’ সংসদের গরিমা ও সংসদীয় রীতিনীতি শিকেয় তুলেছে। প্রধানমন্ত্রীকেও করে তুলেছে ‘নির্বিকার যথেচ্ছাচারী’। তাই তিনি সর্বদলীয় বৈঠকে হাজির না-হওয়ার স্পর্ধা দেখান। সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার সম্মিলিত বিরোধী দাবি ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেন। অসম্মানের কঁাটাকে সম্মানের মণিহার ভেবে গর্ব বোধ করেন। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন বিরোধী স্বর।
এবার বিরোধীরা মনে করছে পহেলগঁাও কাণ্ড, ‘অপারেশন সিঁদুর’, বাণিজ্য হুমকি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধ থামানোর দাবি, বিহারের ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে নির্বাচন কমিশনের অহেতুক তৎপরতা কিংবা বিদেশি খেদাওয়ের নামে বাংলাভাষীদের অবিরাম হেনস্তার প্রসঙ্গ তুলে সরকারকে বিপাকে ফেলবে। বিদেশনীতির ‘ব্যর্থতা’ কিংবা গোয়েন্দাদের ‘অপদার্থতা’ নিয়ে সরকারকে অপদস্থ করবে। সরকারকে বাধ্য করাবে বিরোধী দাবি মেনে আলোচনায় রাজি হতে। প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহিতে বাধ্য করাবে। কিন্তু পারবে কী? এটাই হয়ে দঁাড়িয়েছে এই অধিবেশনের মুখ্য আকর্ষণ। নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার জোয়ার যেভাবে বিরোধীদের খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিচ্ছে, বিরোধী প্রতিরোধ ঠুনকো
প্রতিপন্ন করেছে, এবারেও হয়তো তারই পুনরাবৃত্তি হবে।
মোদি মোটেই স্বীকার করবেন না লড়াইটা ট্রাম্পই থামিয়েছেন, বাণিজ্য হুমকির ধমকানিতে দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। সম্ভবত বুক ঠুকে এটাও বলা যায়, ক’টা ফাইটার প্লেন ভারত খুইয়েছে, চারটে, পঁাচটা না কি স্রেফ একটা, সরকার সে-হিসাবও দাখিল করবে না। জানানোর হলে এতদিনে জানিয়ে দিত। সর্বদলীয় বৈঠকে নিজে না থেকে যিনি রাজনাথ
সিং-কে এগিয়ে দিয়েছিলেন, অপারেশন সিঁদুর নিয়ে বিতর্কে জবাবি ভাষণের দায়িত্বে প্রধানমন্ত্রী হয়তো তঁাকেই এগিয়ে দেবেন। ট্রাম্প সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দেওয়াবেন জয়শঙ্করকে দিয়ে। বিতর্কের মাঝে নিজের কথা নিজে জাহির করবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু জবাবদিহি নয়। ১১টা বছর ধরে সংসদে এমনটাই দস্তুর।
মোদি বন্দনায় এবারও অধিবেশন মুখরিত থাকবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে ‘ব্রুট মেজরিটি’-র মজা ও মাহাত্ম্য এটাই। সংখ্যাগরিষ্ঠের দশচক্রে ভগবান যেমন ভূত হন, ভূতও তেমন ভগবান হয়ে ওঠে। সেটা কেমনভাবে হয়, একটি ঘটনার উল্লেখ করলে তা বোঝা যাবে। বর্ষাকালীন অধিবেশনের প্রাক্কালে ওই খবর আজকের নতুন ভারতের বদলে যাওয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক চরিত্রের একটা জ্বলজ্বলে দলিল। যদিও সেই খবর এই মারাত্মক অশুভ প্রবণতা থেকে পরিত্রাণের উপায়ের হদিশ দেবে না।
পাঁচ বছর আগে সারা পৃথিবী ওলটপালট করে দিয়েছিল কোভিড ১৯। করোনাভাইরাস ছেয়ে গিয়েছিল বিশ্বে। বাদ যায়নি ভারতও। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি কেরলের তিন শহরে করোনা ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। পুরো ফেব্রুয়ারি মোদি-সরকার গড়িমসি করেছে। মার্চ মাসের প্রথম তিন সপ্তাহ মোদির দল ও সরকার ব্যস্ত ছিল মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটাতে। ‘কোভিড ১৯’ তত দিনে লাগামছাড়া। অথচ প্রধানমন্ত্রী ভ্রুক্ষেপহীন। ২৩ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিলেন কমলনাথ। সেদিনই নতুন মুখ্যমন্ত্রী হলেন বিজেপির শিবরাজ সিং চৌহান। দু’দিন পর ২৫ মার্চ লকডাউনের ঘোষণা হল।
স্মরণ করে দেখুন, করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারি টালবাহানা ও ব্যর্থতার দায় এক সপ্তাহের মধ্যে কীভাবে একটা সম্প্রদায়ের ঘাড়ে চাপানো হয়েছিল। মার্চের ৯ ও ১০ তারিখে দিল্লির নিজামউদ্দিন এলাকায় তবলিঘি জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে যোগ দিতে দিল্লি এসেছিলেন ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৯ হাজার ইসলাম ধর্মপ্রচারক।
২৫ তারিখ লকডাউন হয়ে যাওয়ায় ওই ধর্মপ্রচারকদের অনেকেই দিল্লি-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে আটকে পড়েন। রাতারাতি শুরু হয় বিজেপির প্রচার– মুসলমানদের ওই জামাত করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। দিল্লি পুলিশ ১৮৯৭ সালের মহামারী আইন, ২০০৫ সালের
বিপর্যয় মোকাবিলা আইন এবং দিল্লি পুলিশের জমায়েত বিরোধী নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে মামলা দায়ের করে দেশি-বিদেশি মুসল্লিদের বিরুদ্ধে। বিদেশিদের বিরুদ্ধে ভিসা আইন লঙ্ঘনেরও মামলা রুজু হয়। হয়রানির শেষ এখানেই নয়। সুপরিকল্পিতভাবে ওই প্রচারের পাশাপাশি ছড়ানো হয় তীব্র ঘৃণা। রাজস্থান, পাঞ্জাব, কর্নাটক, অরুণাচল প্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাত, মহারাষ্ট্রে অত্যাচারিত হন নিরীহ মুসলমানরা। শুরু হয় সামাজিক বয়কট। পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় নিরপরাধ মুসলমান ট্রাকচালকদের। করোনাভাইরাস ছড়ানোর মিথ্যা অপবাদে রাজ্যে রাজ্যে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন হাজার-হাজার মুসলমান।
সংসদের অধিবেশন শুরুর দু’-দিন আগে, ১৯ জুলাই, দিল্লি হাই কোর্ট রায় দিয়েছে, নিজামউদ্দিনের তবলিঘি জামাত থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়নি। সবার বিরুদ্ধে আনা দিল্লি পুলিশের সব মামলা খারিজ করে হাই কোর্টের বিচারপতি নীনা বনসল কৃষ্ণা বলেছেন, একটি অভিযোগও দিল্লি পুলিশ প্রমাণ করতে পারেনি। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার অভিযোগও ধোপে টেকে না। দিল্লি পুলিশকে বিচারপতির প্রশ্ন, লকডাউনের মধ্যে আশ্রয়দাতারা মুসল্লিদের ফেরত পাঠাতেন কী করে? তঁারা তো নিরুপায়! গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের দশচক্রে কার-কী হাল হয় তবলিগি জামাত মামলা তার নির্দয় নমুনা।
বিরোধীরা সংসদে মাথা কুটেই যাবেন। ‘ব্রুট মেজরিটি’-র তাতে কিছুই যায়-আসে না। উপ-রাষ্ট্রপতির পদত্যাগও বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘ব্রুট মেজরিটি’-র জন্ম দেওয়া ‘নির্বিকার যথেচ্ছাচারিতার’ স্বরূপ কেমন। বর্ষাকালীন অধিবেশন তাই ব্যতিক্রমী হবে না। অতীতের পুনরাবৃত্তিই ঘটবে।
সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।