শেষ জীবনের যন্ত্রণা

শেষ জীবনের যন্ত্রণা

খেলাধুলা/SPORTS
Spread the love


  • রূপেন্দু দাস

বাংলা আকাদেমির একতলার ঘরে বসে একমনে কাজ করছেন। পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। ভিতরে গিয়ে বসতে একজনকে দুটো চা দিয়ে যেতে বললেন। যথারীতি চা এল। চা খেতে খেতে কথা। আচমকা কাপ থেকে চা চলকে পাঞ্জাবিতে পড়ে গেল।

হাত দিয়ে সেই চা তুলতে তুলতে বললেন – ‘কপাল ভালো। এটা বাংলা আকাদেমির চা’। বুঝতে অসুবিধে হল না কী বলতে চাইলেন। উনি বোঝাতে চাইলেন, এই চা বাংলা আকাদেমির। তাই কাপড়ে দাগ লাগার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এমন রসিক মানুষটি জ্যোতিভূষণ চাকী। বেঁচে থাকলে এবারই তাঁর একশো বছর হত। কলকাতার জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউটে পড়ার সুবাদে স্যরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ক্লাস নাইনে ওঠার পর দরকার হয় বাংলা ও ইংরেজির একজন মাস্টারমশাইয়ের। খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। স্কুলেই তো রয়েছেন। ১৯৮৮ সালে কোনও এক সকালে চলে গেলাম  ৮১, কাঁকুলিয়া রোডের  তিনতলায় স্যরের বাড়িতে।  পশ্চিমমুখ চওড়া বারান্দার কাঠের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে রয়েছেন। দু’পাশে পড়ুয়ারা।

পাণ্ডিত্য অনেকেরই থাকে। কিন্তু তা সহজসরল ভাষায় সাধারণ পাঠকের কাছে তুলে ধরার কৌশল সকলে জানে না। জ্যোতিভূষণ একদিকে ভাষাবিদ, অন্যদিকে তিনি আবার ভাষাতাত্ত্বিক। অধিকাংশ ভাষাবিদ ভাষাতাত্ত্বিক নন। আবার ভাষাতাত্ত্বিক বহু ভাষা নাও জানতে পারেন। কিন্তু জ্যোতিভূষণ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী অন্যদিক থেকেও। খুব কঠিন বিষয়কে খুব প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারতেন।

পরীক্ষার পাঠ চুকেবুকে যাওয়ার পরেও স্যরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ছুটির দিন সন্ধ্যা হলেও আর পাঁচজনের মতো আমারও ঠিকানা হয়ে উঠত কাঁকুলিয়া রোডের ওই তিনতলা বাড়ি। নানা বিষয়ে কথাবার্তা হত। তাই, মানুষটাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। শুনেছিলাম বহু অজানা কথা।

জীবনের শেষবেলায় অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে দিেয় কাটাতে হয়েছিল সবার প্রিয় জ্যোতিভূষণকে। স্ত্রী প্রকৃতি আক্রান্ত হন অ্যালজাইমারসে। চেনা মানুষ তখন তাঁর কাছে অচেনা-অজানা হয়ে উঠেছিল। এমনকি নিজের জীবনসঙ্গীকেও তিনি চিনতে পারতেন না। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন প্রকৃতি। নিজের হাতে খেতে পারতেন না। কখনও স্যর তাঁকে খাইয়ে দিতেন। কখনও আয়ার হাতে স্ত্রীকে খেতে হত। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী বিছানা। পাশে থাকতেন কখনও আয়া, কখনও স্যর।

শেষজীবনে জীবনসঙ্গী সকরুণ অবস্থা তাঁকে প্রতিনিয়ত পীড়া দিত। মাঝেমধ্যেই বলতেন সেই যন্ত্রণার কথা। স্যরের সংগ্রহে ছিল পাঁচশো অভিধান। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য, নিজের অর্থকষ্টকে প্রশমিত করতে স্যরকে সেই বই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বিক্রি করেছিলেন ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিওন’ বইটির সবক’টি পর্ব। এছাড়াও আর কত দামি বই বিক্রি তিনি বিক্রি করেছিলেন, তার কোনও হিসেব নেই। বই বিক্রি করে খুব বেশি টাকা পাওয়া যায় না। বইওয়ালারাও ঝোপ বুঝে কোপ মারেন।

চোখমুখ দেখলে বুঝতে পারেন, কে যেভাবে হোক বই বিক্রি করবে। যে বই কিনেছেন ৪০০ টাকায়, সেই বই বিক্রি করে অর্ধেক দাম তো পাওয়া যাবে না। মেরেকেটে খুব দয়া হলে ১৫০ টাকা। যন্ত্রণায় দীর্ণ প্রকৃতিও একসময় তাঁকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যান। স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি একা এবং একা। জীবনের শেষ দিন িতনি হয়ে উঠেছিলেন একাচারী। প্রিয়জন এলে তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন।

একদিন বারান্দায় কাঠের চেয়ারটায় বসে মনের কষ্ট বুকে চেপে শুনিয়েছিলেন বই বিক্রির করুণ কাহিনী। কেন বিক্রি করেছিলেন সেটা সরাসরি না বললেও ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের চাপ, এর-তার দাবি পূরণ করা।  কারও দাবি পূরণ করতে না পারলে তার আবার মুখ ভার। কোনও এক অজনা কারণে স্যর পেনশন পাননি। ছাত্র পড়িয়ে, বাংলা আকাদেমিতে কাজ করার সুবাদে সংসার একপ্রকার চলে যাচ্ছিল। পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি।

কোনও এক সন্ধ্যায় বন্ধুসমা প্রকৃতি এবং সংসারের কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল। সেই যন্ত্রণা প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একটি গানের দু’কলি শুনিয়ে – ‘আরো আঘাত সইবে আমার/ সইবে আমারো/ আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো/ যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে/ বাজেনি তা চরম তানে/নিঠুর মূর্ছনায় যে গানে/ মূর্তি সঞ্চারো। স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসতেন, তা জানাতে গিয়ে শুনিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অন্ধকারে’ কবিতার এই কয়েকটি লাইন – ‘তুমি এসেছিলে‒ চিহ্ন পাই প্রিয়, পথ জুড়ে অন্ধকারে বেজে ওঠে‒ ‘যাই’ চেয়ে দেখি, কেহ কোথা নাই তৃণে ও অঙ্কুরে।’

বাংলা আকাদেমি থেকে অবসরের পর জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই কোনও আমন্ত্রণ এলে ফেরত পাঠাতেন না। চলে যেতেন। জানতেন, গেলেই কিছু পারিশ্রমিক জুটবে। দুঃখ করে একবারে বলেছিলেন, ‘এখন এই  সব উঞ্ছবৃত্তি না করলেই নয়।’ কালি আর কলমকে যে মানুষটা মনে প্রাণে ভালোবেসেছিলেন, পড়ন্ত বেলায় সেই লেখাকে তিনি বলছিলেন ‘ফাইফরমাশের কাজ’ ।

এত কষ্টের মধ্যে দিয়ে চললেও সর্বদা হাসিমুখ। স্কুল থেকে পেনশন না পাওয়ায় কঠিন হয়ে পড়ে জীবন। স্কুলের যে সব মাস্টারমশাইরা অবসরজীবন কিছুটা হলেও স্বচ্ছন্দে চলছিল, জ্যোতিবাবুর ক্ষেত্রে ঠিক উলটো। সকালে পড়াতে পড়াতে বেশ কয়েকবার চা। স্নান করে খেয়ে দেয়ে টু-বি বাস ধরে রবীন্দ্রসদনে নেমে টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে বাংলা আকাদেমিতে। বিকেল ৫টা-সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে কোনওরকমে বাসে উঠে বালিগঞ্জে নেমে আবার হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরা। সন্ধ্যায় আকাদেমি বা অন্য কোনও জায়গায় আলোচনা সভা থাকলে সেখানে চলে যাওয়া। বাড়ি ফিরে অসুস্থ স্ত্রীর খোঁজ নিয়ে ফের কাজে বসা।

বেশ কিছুদিন বাদে উপলব্ধি করি, পাঞ্জাবিতে চা পড়ে যাওয়া নিয়ে কেন এমন রসিকতা করেছিলেন। আসলে আর্থিক কারণে বেশি দামি জামাকাপড় কেনার দুঃসাহস দেখাতে পারেননি। তাই, সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি যতদিন সম্ভব সাদা রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর জীবনটাও ছিল সাদামাঠা।

রামায়ণের মতো কঠিন বিষয়কে খুব সহজে ছোটদের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ছোটদের জন্য অজস্র বই লিখেছিেলন। আর সেই সঙ্গে তাঁর রসবোধ। সেই রসবোধের উল্লেখ করে ইতি টানি।

পরীক্ষা হলে গার্ড দিতে ঢুকে প্রথমেই ছাত্রদের স্যর বলে দিলেন- ‘কথা হবে না। খালি কলম চলবে।’ খাতা দেওয়ার পর একটু হেসে বললেন– ‘আমি কোথাও গেলে তোরা কথা বলতে পারিস। এতে দোষ নেই।’

তাঁর জ্যোতিতে আজ অনেকেই আলোকিত।   স্যর, জন্মশতবর্ষে আপনাকে প্রণাম।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *