- শুভঙ্কর ঘোষ
সুনীতারা শেষপর্যন্ত সময়ের নিখুঁত পরিমাপে পৃথিবীতে ফিরে এলেন। নির্ধারিত ৮ দিনের পরিবর্তে ২৮৬ দিনের মহাকাশবাসে এবার যোগ হয়েছিল নানা মাত্রা। সুনীতারা পৃথিবীকে ৪৫৭৬ বার প্রদক্ষিণ করে, প্রায় ১৯৫০ লক্ষ কিলোমিটার অতিক্রম করে ফেরার পর সাধারণ মানুষ জানতে পারলেন, মহাকাশ প্রযুক্তির নানা উন্নতির রূপকথার আখ্যান।
এবার ফেরার সময় ড্রাগন ক্যাপসুলের বাইরে ছিল তাপ নিরোধক আস্তরণ পিকা – কার্বনের চাদর ফেনোলিক যৌগযুক্ত। এতে মহাকাশযানের যাত্রীদের নিরাপত্তা আরও সুনিশ্চিত হয়েছে। ভবিষ্যতে মহাকাশ গবেষণা ও ভ্রমণার্থীদের জন্য যাত্রী ও মাল পরিবহণে আরও বেশি ব্যবহৃত হবে মহাকাশযান। আরও একটি বৈজ্ঞানিক মাইলফলক হল, ছ’টি প্যারাসুটের নিখুঁত ব্যবহার। প্রথমে দুটি এবং শেষে চারটি প্যারাসুটের সাহায্য নিয়ে ঘণ্টায় ১৬ মাইল বেগে ফ্লোরিডার কাছে মেক্সিকো উপসাগরের বুক স্পর্শ করে ড্রাগন। এই মুহূর্তে কয়েক যোজন এগিয়ে গেল আমেরিকা, আরও সংক্ষেপে বললে নাসা। বিশেষ করে অর্থনৈতিক, সামরিক ও সবধরনের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পড়শি দেশ চিনের তুলনায়।
আমেরিকায় পূর্ব-পশ্চিম দুটি দিকের তটভূমি ভ্রমণের সময় আমার একটি অন্যতম কৌতূহলের বিষয় ছিল, নানা বিজ্ঞান ও কারিগরি মিউজিয়াম ঘুরে দেখা। স্মিথসোনিয়ান সংস্থার দুটি মহাকাশ মিউজিয়াম রাজধানী ওয়াশিংটনে ও ভার্জিনিয়ায়। দুটো ভীষণ উদ্দীপ্ত করার মতো। ডিসকভারি মহাকাশযানকে সামনে থেকে দেখা, তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা প্রত্যক্ষ এবং নানা কারিগরি দিকের সম্যক ধারণা করা অত্যন্ত উত্তেজনার কারণ ছিল।
সেখানে গেলে বোঝা যায়, মহাকাশচারীদের পোশাক পরিচ্ছদ কেমন হওয়া দরকার, কীভাবে সেগুলি তৈরি হয়, কেমন ধরনের খাবার, কেমন ধরনের ওষুধ সঙ্গে রাখতে হয় সেগুলি চাক্ষুষ করেছিলাম। আক্ষেপ হচ্ছিল, সেদেশের শিশু থেকে বয়স্ক সকলেই মহাকাশে যাত্রার ইতিহাসের প্রতিটি উপকরণ ও ব্যবহার স্বচক্ষে দেখতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন ইতিহাস রচনা করতে নিজেদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে অনায়াসে। অ্যাপোলো মডিউলের ভিতরে মহাকাশচারীদের কীভাবে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রবল প্রতিকূলতাকে সামলে মিশন সফল করতে হয়, তার অনুভূতি না পেলেও রোমাঞ্চ জাগে সামনে থেকে দেখলে।
মহাকাশ স্টেশনে প্রাত্যহিক রুটিন মোটামুটি একই রকম। নিয়মিত পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশনকে জানাতে হয় সবকিছু। দিনে অনেকবার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে অভ্যস্ত মহাকাশবাসীরা নানা ধরনের গবেষণা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেন। কখনো-কখনো মহাকাশ স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে স্পেস ওয়াক অর্থাৎ হাঁটা একটি অবিচ্ছেদ্য কর্মকাণ্ড। তাঁদের ঘুমোনোর জন্য বার্থ, টয়লেট, ফ্রিজ, মিনিজিম ওয়াকার কী নেই সেখানে! চিনের তিয়ানগং স্টেশনে তো সম্প্রতি মাইক্রোওয়েভ মেশিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে গরম খাবারের স্বাদও মিলবে। এবছরের শেষ দিকে সুনীতারা ক্রিসমাস পালন করেছেন কেক কেটে। সীমিত জায়গায় বিনোদনের উপকরণ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা আজও চলছে।
এমনিতে মহাকাশের বুকে বাসস্থান গড়ার কল্পনা অনেক পুরোনো। বিখ্যাত জোতির্বিদ জোহানস কেপলার সপ্তদশ শতকের প্রথমদিকে ভেবেছিলেন পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহনক্ষত্রের মাঝখানে যে বিপুল পরিমাণ স্থান তার ব্যবহার মানবজাতিকে করতেই হবে। ১৮৬০ সালে এডওয়ার্ড হালি তার ‘ব্রিক মুন’ কল্পকাহিনীতে এমন মহাকাশে বসবাসযোগ্য কিছুর বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তুলে ধরেন। এরপর রুশ তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী সিওলকভক্সি এমন মহাকাশ বাসাতে সৌরশক্তির ব্যবহার ও শাকসবজি চাষের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
হার্মান নুরদং ১৯২৮ সালে একটি হুইল আকারের মহাকাশ গবেষণাগার ডিজাইন করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহাকাশ অভিযানের জন্মলগ্ন থেকেই নাসা মহাকাশ বাসস্থান বা স্টেশন নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে। ছোট আকারের মহাকাশ স্টেশন বানিয়ে ফেলে দুই শক্তিধর দেশ – আমেরিকা ও রাশিয়া। পরে যোগ দেয় চিন। রাশিয়ার মির, আমেরিকার স্কাইল্যাব, রাশিয়ার সয়ুজ স্যালুট এদের নানা ভার্সন, চিনের তিয়ানগং-১, ২ সব আজ ইতিহাস। বিংশ শতাব্দীর শেষেই জন্ম নিল আইএসএস – অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।
আমেরিকার নাসা সহ মোট পাঁচটি দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রাশিয়ার রসকসমস, জাপানের জেক্সা, ইউরোপের ইএসএ এবং কানাডার সিএসএ সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে পৃথিবীতল থেকে ৩৭০ থেকে ৪৬০ কিলোমিটার ওপরে ঘূর্ণায়মান এই অতিকায় পরীক্ষাগার। ১০৯ মিটার লম্বা আর ৫১ মিটার চওড়া এই স্টেশনের ভিতরে আছে মহাকাশচারীদের থাকা খাওয়া ও গবেষণার ব্যবস্থা। মহাকাশ স্টেশনের ভিতরে কৃত্রিমভাবে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ তৈরি করা হয়। ঘণ্টায় প্রায় ২৮০০০ কিলোমিটার বেগে নির্দিষ্ট উচ্চতায় অবিরাম ঘুরে চলেছে এটি। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব এই উচ্চতায় নগণ্য হলেও বিবেচ্য। বায়ুর বাধা ও ঘর্ষণ কাটিয়ে তাই চলার পথে দরকার স্টেশন মধ্যকার নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে শক্তি।
স্টেশনের দুই প্রান্তে যে সৌর কোষের প্যানেল আছে ২২৪৭ বর্গমিটার ক্ষেত্রজুড়ে তাতে উৎপন্ন ৭৩৫ মেগাওয়াট বৈদুতিক শক্তি দিয়ে চলে স্টেশনের সব কাজ। নিউক্লীয় বা পারমাণবিক শক্তির বিকল্প থাকলেও এক্ষেত্রে অপ্রচলিত পরিবেশবান্ধব সৌরশক্তির ব্যবহার অত্যন্ত উৎসাহজনক পদক্ষেপ।
আরও একটি মহাকাশ স্টেশন এই মুহূর্তে সক্রিয়। আমেরিকা ও চিনের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস অবিশ্বাসের সাম্প্রতিক আবহে মহাকাশ গবেষণা অন্তর্ভুক্ত। চিনের মিলিটারি শাসনের ছত্রছায়ায় সেদেশের মহাকাশ অভিযান ও গবেষণা পরিচালিত হয়। ২০১১ সাল থেকে উল্ফ সংযোজনী অনুসারে ইউএস কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া চিনকে নাসার কোনও কার্যক্রমে সংযুক্ত করা যাবে না।
একলা চলো রে নীতির অনুগামী চিন প্রথম ধাপে সফল হয়নি। শেষে সফল হল তিয়ানগং অর্থাৎ স্বর্গীয় অট্টালিকা। প্রায় ৭০ টন ওজনের ৫৫ মিটার দীর্ঘ প্রাথমিকভাবে তিনটি মডিউল নিয়ে এটি প্রতি সেকেন্ডে ৭.৬৮ কিলোমিটার বেগে ঘুরে চলেছে ৪২৫ কিলোমিটার উচ্চতায়। ইতিমধ্যে অনেক চিনা তাইকোনট বা মহাকাশচারী এই স্টেশনে পৌঁছে ফিরেও এসেছেন। চিনা ভাষায় তাই কং হল মহাকাশ। বহির্বিশ্বে তাইকোনট বললেও চিনারা মহাকাশচারীদের বলেন ইউ হাং উয়ান বা হাং তিয়ান উয়ান। এখানেই স্বাতন্ত্র্য। যেটা ভারতের কাছে যথেষ্ট অনুপ্রেরণার। ইতিমধ্যে মোট ১৭ জন তাইকোনট মহাকাশে হেঁটেছেন। ২০০৩ সালে প্রথম ইয়াং লিউয়ি সেনঝাও নামের মহাকাশযানে চেপে ইতিহাস তৈরি করেন। তিয়ানগং আয়তনে আইএসএসের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ হলেও ভবিষ্যতে চমকপ্রদ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী প্রতিশ্রুতির আধারে সম্ভাবনাময়।
এই মুহূর্তে ১০ জন মানুষ মহাকাশে আছেন, যেমন বিগত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত হচ্ছে। সাতজন আইএসএস আর তিনজন তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশনে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সুনীতাদের মহাকাশে আটকে পড়া ও ঘরে ফেরা সংবাদ ও বৈদুতিন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়ে যায়। সাধারণ মানুষ এবার কৌতূহলী জানতে, মহাকাশচারীরা কীভাবে সেখানে পৌঁছে যান, কত সময় লাগে, যাতায়াত ও স্টেশনে থাকাকালীন কী খান। ঘুম, স্নান সহ প্রাত্যহিক কাজ কীভাবে করেন। বিনোদনের কী ব্যবস্থা সেখানে।
দীর্ঘদিন মহাকাশে থাকলে কয়েকটি সমস্যা আসবেই। অভিকর্ষহীন অবস্থায় মানুষের দেহের হাড়ের ওজন কমে যায়। এছাড়াও আছে মহাকাশে বিকিরণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা। ক্যানসার সহ নানা রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আবার দীর্ঘদিন ছোট জায়গায় আবদ্ধ থাকার জন্য মানসিক নানা সমস্যা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। পৃথিবী থেকে বিশাল দূরত্বের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। মহাকাশযান এবং স্টেশনের মধ্যে ঠিকঠাক তাপমাত্রা, পারিপার্শ্বিক চাপ ও আলো বজায় রাখা। অণুজীব সংক্রমণ ও সেই সংক্রান্ত প্রতিরোধ অনুক্ষণ মনিটর করা ভীষণ কঠিন কাজ।
সন্দেহবাতিক ও নিন্দুকদের উপেক্ষা করেই বলি, তাঁদের আটকে পড়া হয়তো বিজ্ঞানের ইতিহাসে শাপে বর। সশরীরে চন্দ্রাভিযানের পর মঙ্গলাভিযান এখন মনুষ্যজাতির কাছে বিরাট স্বপ্ন- দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রার ধকল নিতে পারা বড় চ্যালেঞ্জ। ষাট ছুঁইছুঁই এক মহিলা নভশ্চারী আজ পথ দেখাচ্ছেন ভারতকে, গোটা বিশ্বকে।
(লেখক কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক)