শুধু বিরিয়ানি? শুধু একদিনের পরীক্ষা?  

শুধু বিরিয়ানি? শুধু একদিনের পরীক্ষা?  

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


 

  • রম্যাণী গোস্বামী

কলেজের সিক্সথ সিমেস্টারের পডুয়াদের ছিমছাম ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান শেষে ছাত্রছাত্রীরা হাসিমুখে ডিপার্টমেন্টের টিচারদের হাতে বিরিয়ানির প্যাকেটগুলো তুলে দিচ্ছিল। বেলা চারটে। তাই খিদেটাও পেয়েছিল জব্বর। কিন্তু প্যাকেট খুলে গরম গরম খাবারটা মুখে তোলার আগেই দুম করে পোড়ামুখো মন কু ডাকল – এও ‘কমোড বিরিয়ানি’ নয়তো!

ভেবেই পেটের ভিতরে অনিচ্ছার গুড়গুড়। গুটিয়ে এল হাত। প্যাকেট দিচ্ছিল যে ছাত্রটি, সে আমার কোঁচকানো ভুরু দেখে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে একগাল হেসে বলল, একদম ফার্স্টক্লাস জায়গা থেকে আনা ম্যাডাম। ভয় পাবেন না।

কথাটা শুনেই ওকে বলতে ইচ্ছে হল, ‘ফার্স্টক্লাস জায়গা’? বটে? তুমি নিজে ওদের হেঁশেলে ঢুকে দেখেছ কিনা? তারপরই মনে হল, চারপাশে এই যে এত শয়ে-শয়ে খাবারের দোকান – এগরোল, মোমো, চপ, চাউমিনের ছড়াছড়ি- তার ক’টার হেঁশেলে খোদ আমি ঢুকে দেখেছি? উঁকি দেওয়ার অবকাশ বা সুযোগ কোনওটাই কি রয়েছে? মাত্র কিছুদিন আগে শিলিগুড়ির প্রাণকেন্দ্রে জনপ্রিয় একটি রেস্টুরেন্টে আচমকা হানা দিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আধিকারিকের দল যা দেখলেন, তাতে শোরগোল পড়ে গেল শহরের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। তবে কি এতদিন আমরা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলাম?

গত পাঁচ বছরে বাঘা যতীন পার্ক, কলেজ পাড়া, হিলকার্ট রোড, এসএফ রোড, সেবক রোড, বিধান মার্কেট, ভিড়ে ঠাসা হংকং মার্কেটের ভিতরে ও বিভিন্ন শপিং মলের বাইরে রাস্তায় গজিয়ে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য রেস্তোরাঁ, ক্যাফে আর স্ট্রিট ফুডের স্টল। তাদের মধ্যে কজনের কাছে খাদ্য সুরক্ষা দপ্তরের অনুমোদিত লাইসেন্সটি রয়েছে সেটা কারও জানা নেই। ‘ফুড সেফটি’ আর ‘হাইজিন স্ট্যান্ডার্ড’ এই দুটো শব্দকে অবহেলায় উড়িয়ে দিয়ে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সস্তায় ও সুলভে পাওয়া যাচ্ছে জিভে জল আনা রংচঙে সব খাবার। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সবজি, মাংস ইত্যাদি কাটা-ধোয়া, বাছাই ও রান্না চলছে। লোভনীয় চিকেন তন্দুরির ওপরে ক্রমাগত উড়ে এসে বসছে মাছি। রাস্তার ধুলোবালির আস্তরণ গিয়ে জমছে চিজ স্যান্ডউইচের গায়ে। হাইড্রেনের ধারে একটামাত্র গামলার জলে চায়ের কাপপ্লেট, খাবারের এঁটো থালা চুবিয়ে রেখে সেগুলো সেখানেই মাজাধোয়া চলছে। কারও কোনও তাপউত্তাপ নেই!

অথচ বাইরে থেকে শহরের কলেজগুলোয় পড়তে আসা মেস করে থাকা এবং লোকাল স্টুডেন্ট উভয়ের ভিড় উপচে পড়ে এইসব দোকানগুলোর গায়েই। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর, টিউশন সেরে ফেরার পথে। কেউ কেউ আবার রাতের জন্য রুটি-তরকা কিংবা এগ চাউমিন অথবা চিকেন বিরিয়ানি প্যাক করে নেয় এখান থেকেই। পকেটে টান। তাই এরাই তো ভরসা। এভাবেই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নিজেদের অজান্তেই তাদের শরীরে ঢুকিয়ে ফেলছে নানা ধরনের ক্ষতিকর রোগজীবাণু।

বিরিয়ানিতে ব্যবহৃত কৃত্রিম রঙে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে অনেক আগেই। তাছাড়াও বিরিয়ানি বা ফ্রায়েড রাইসে নির্বিচারে ভেজাল মশলা দেওয়া, মোমো, বার্গার, পিৎজায় দেদার বাসি ময়দা ও বাসি চিকেনের ব্যবহার, স্বাদ বাড়ানোর জন্য চাউমিনে মাত্রাতিরিক্ত আজিনামোটোর প্রয়োগ ডেকে আনছে ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়ার মতো মারাত্মক জিনিসকে। শুধু একদিনের পরীক্ষায় কী হবে? এমন পরীক্ষা নিয়মিত হওয়া উচিত। সব খাবার নিয়ে।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। শহরের এক কলেজে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা নিতে গিয়েছি এক্সটারনাল এগজামিনার হিসেবে। একজন ছাত্রী পরীক্ষা দিতে এসেই প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়ল। বমি, পেটে ব্যথা, সমস্ত শরীরে খিঁচুনি। পরে জানা গেল যা সন্দেহ করেছি তাই। সে কলেজের কাছেই একটি মেস ভাড়া করে থাকে। গতরাতে গলির মোড়ের এক সস্তার দোকান থেকে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন কিনে খেয়েছিল। সেটা খেয়েই তার এই হাল। তাই বলে ভালো বিক্রেতা কি নেই?

এই তো, পালপাড়া মোড়ের কাছে একজন বৌদি বসেন মোমো-চাউমিন নিয়ে। নির্ভেজাল ঘরোয়া মশলা। পরিষ্কার-পরিপাটি। খুব বেশি বিক্রিও করেন না। দিনের খরচটা উঠে গেলেই, ব্যস। আসলে সমস্যা ঘটায় কিছু ব্যবসায়ীর সীমাহীন লোভ এবং কিছু ক্রেতার সঠিক দামের বদলে সস্তার জিনিস কেনার প্রবণতা। অনেক ক্ষেত্রেই কোয়ালিটি ফুড দিতে গেলে তার দামও বাড়বে। ক্রেতা তখন অরাজি হলে চলবে কীভাবে?

আর এ তো গেল অলিতে-গলিতে গজিয়ে ওঠা সস্তার হোটেলের কথা। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্সধারী দামি রেস্তোরাঁগুলোকেও কি পুরোপুরি ভরসা করা যায়? সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারা যায় শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবার জোগান দেওয়া বড় ছোট কেটারিং সংস্থাগুলোকে? হয়তো না। তাহলে অনলাইনে নিজের জন্মদিনের কেক অর্ডার করে তা খেয়ে মৃত্যু ঘটত না কিশোরীর। এক নামী রেস্টুরেন্টে চিকেনের পদ খেয়ে পরদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে দেখা যেত না কোনও তরুণকে। এমনকি একটি মহার্ঘ এক্সপ্রেস ট্রেনে জার্নি করার সময় সেখানকার খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন না প্রায় তিরিশজন যাত্রী।

খাবারের পাশাপাশি পানীয়ের কথাতে আসা যাক। গরম বাড়তেই রাস্তায় রাস্তায় শরবত, আখের রস, কাটা ফলের পসরা নিয়ে হাজির হয়েছেন দোকানিরা। ঠান্ডা লস্যি, মিল্ক শেক, নানা রঙের মোহিতো ইত্যাদি বিকোচ্ছে দোকানে দোকানে। এইসব ক্ষেত্রে কী ধরনের জল ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই জলের উৎসই বা কী, কেউ জানে না। কাটা ফলে ব্যাকটিরিয়া খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে আর দূষিত জল বহু রোগের কারণ। ঠিক এক বছর আগে মে মাসেই এই শহর অভূতপূর্ব জলসংকটে পড়েছিল। শিলিগুড়ি পুরসভার জলে দূষণের মাত্রা হয়ে গিয়েছিল লাগামছাড়া। মোদ্দা কথা পানের একেবারেই অযোগ্য। তা না জেনেই পাড়ায় পাড়ায় লোকে সেই জল পান করেছেন লাগাতার। মহানন্দার জলেও অজস্র ব্যাকটিরিয়ার সন্ধান মিলেছে। তাই সিলড বোতলে যে পানীয় জল শহরের দোকানগুলোয় নিয়মিত হারে বিক্রি হয় তাদের মান সম্পর্কে কিছু সংশয় থেকেই যায়।

কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন এত বাড়াবাড়ির কী আছে? সকলেই তো খাচ্ছে। সবাই তো আর অসুস্থ হয়ে পড়ছে না! তাঁরা লক্ষ্য করে দেখবেন কী হারে পেটের অসুখ, গ্যাস্ট্রিক আলসার ছড়িয়ে পড়েছে জনসমাজে। বেড়েছে টাইপ-টু ডায়াবিটিসের মতো ব্যাধি। তাই এর সমাধানসূত্র খোঁজা দরকার। স্বাস্থ্য আধিকারিকদের নিয়মিত হস্তক্ষেপের পাশাপাশি প্রয়োজন শহরের সাধারণ নাগরিকদের সচেতনতাও। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে তেলমশলা, রং দিয়ে খাবারকে চটকদার বানিয়ে তুললে সেই খাবার কিনতে অস্বীকার করুন। অপরিচ্ছন্নভাবে খাবার পরিবেশন করা হলে সঙ্গে সঙ্গে তা ফেরত দিন।

শিলিগুড়ির ফুড ব্লগাররাও সোচ্চার হোন প্রতিবাদে। ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়ে ওঠা খাবারের দোকানগুলো ফুড সেফটি স্ট্যান্ডার্ড না মেনে চললে তাদের কাছ থেকে চড়া ফাইন নেওয়া অন্যতম উপায় যা স্বাস্থ্য দপ্তর চালু করতেই পারে। এভাবে একের পর এক অভিযান চালিয়ে গেলে আশা করা যায় সমস্যাগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। রেস্তোরাঁর পানীয় জলের ফিল্টারগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় কি না সেটা দেখা দরকার। একইসঙ্গে খাবারের দোকানে বসবার জায়গার পাশাপাশি ওয়াশরুমগুলোর হাইজিনও কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় যে শুধু শিলিগুড়িতে নয়, অনেক জায়গাতেই বিষয়টি ভয়ংকরভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত।

ক’দিন আগেই রাতের বাসে কলকাতা থেকে ফিরছি। রাতে একটিই স্টপ কৃষ্ণনগরে। নেক্সট স্টপ ভোরে ডালখোলায় রমরমিয়ে চলা একটি ধাবায়। সেখানে লেডিজ ওয়াশরুমের অবস্থা দেখে আমি স্তম্ভিত! অথচ দিনের পর দিন এভাবেই চলছে।

সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিজের গ্রিভান্সেস যথাযথ জায়গায় জানিয়ে তারপর গরম চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তি পেয়েছিলাম।

(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। অধ্যাপক ও সাহিত্যিক)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *