শুধু টেস্ট নয়, ক্রিকেটই মিস করবে কোহলিকে 

শুধু টেস্ট নয়, ক্রিকেটই মিস করবে কোহলিকে 

শিক্ষা
Spread the love


 

  • গৌতম ভট্টাচার্য

টেস্ট থেকে বিরাট কোহলির অবসরকে ঘিরে বিশ্বজোড়া আবেগের স্ফুলিঙ্গ এখন স্বাভাবিক নিয়মেই খানিক স্তিমিত হওয়ার পথে। কিন্তু জুন মাসে যখন ভারতের ইংল্যান্ড সফরের প্রথম টেস্টে দ্বিতীয় উইকেট পতনের পর ড্রেসিংরুম থেকে ব্যাট হাতে ক্রিজের দিকে এগিয়ে যাবে না সকলের পরিচিত সেই ১৮ নম্বর জার্সি, তখন অনেকেই নিশ্চয়ই স্মৃতির সরণি বেয়ে পুরোনো কথা ভেবে বেশ খানিক নস্টালজিক হবেন। সেই অতি পরিচিত স্যোয়াগ, সেই বোলার রানআপ শুরু করার আগে হাতের মধ্যে ব্যাট ঘোরানো, আর সবচেয়ে বেশি গ্যালারি থেকে সেই ‘বিরাট, বিরাট’ চিৎকার! হয়তো দেখা মিলবে না ওদেশের সেইসমস্ত কোহলি ভক্তদেরও, যারা তাঁদের প্রিয় খেলোয়াড়কে একবার দেখার জন্য মাঠে রেকর্ড সংখ্যায় উপস্থিত থাকতেন।

কিন্তু কে জানে হয়তো কয়েকমাসের মধ্যে পুরো দৃশ্যপটই সম্পূর্ণ পালটে গেল। হয়তো সম্পূর্ণ নতুন চেহারার ওই ভারতীয় দল কঠিন এই সফরে নিজেদের চারিত্রিক দৃঢ়তা বজায় রেখে নতুন যুগের সূচনা করে ফেলল। কারণ ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে, অতীতে যখনই হাহাকার উঠেছে যে গাভাসকার কিংবা পরবর্তীতে শচীনের পর কে? তখনই ক্রিকেট দেবতার আশীর্বাদে নতুন কোনও ভারতীয় ব্যাটিং নক্ষত্রের উদয় হয়েছে। চলতি সপ্তাহে দেশজুড়ে যখন আবেগের ঘূর্ণিঝড় উঠেছিল, সেসময় এপ্রসঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘কর্নেল’ দিলীপ বেঙ্গসরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘বিরাট আর রোহিতের অনুপস্থিতি যে বড়সড়ো শূন্যতার সৃষ্টি করবে এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এক্স আর ওয়াই না থাকলে নিশ্চয়ই ‘এ’ অথবা ‘বি’ সেই কাজ করবে। চিরটাকাল তো এমনটাই হয়ে এসেছে।’

অবশ্য বিরাটের টেস্ট অবসরকে ঘিরে আবেগ যতই বেশি হোক না কেন ঠান্ডা যুক্তিতে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের কাছে কিন্তু এটা ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত। ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজের পর তিনি এই ঘোষণা করতে পারতেন কিনা, এবিষয়ে তর্ক যতই জারি থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে কেবল ২০১৮-এর সিরিজ ছাড়া ইংল্যান্ডের মাঠে সাদা জার্সিতে কোহলির পারফরম্যান্স মোটেও ‘বিরাট’ নয়। সেইসঙ্গে শেষ পাঁচ বছরে যে তাঁর টেস্ট ব্যাটিং গড় ৩০-এর সামান্য বেশি ছিল এবং এই সময়ে একদা ‘টন মেশিন’ যে লাল বলের ক্রিকেটে মাত্র তিনবার তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছেন সেটাও তো ভুলে যাওয়া যায় না।

কিন্তু আমার জন্য ক্রিকেটের দীর্ঘতম ফর্ম্যাট থেকে কিং কোহলির এই যে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া সেটা কেবল শুষ্ক পরিসংখ্যানের চেয়েও খানিক বেশিকিছু। শেষ একসপ্তাহে সবচেয়ে বেশিবার যে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটা হল বিরাট কোহলি টেস্ট ক্রিকেটের ঠিক কত বড় অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু আমি বিষয়টিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে বলতে চাই, ভবিষ্যতে বিরাট যতটা না ক্রিকেটকে মিস করবেন তার থেকে অনেকবেশি বিরাটকে মিস করবেন শুধু টেস্ট নয় বরং সামগ্রিকভাবে গোটা ক্রিকেটই।

এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে উপমহাদেশের মানুষের তথাকথিত ধর্ম ক্রিকেট এখন এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ২০১৩ সালে যখন শচীন তেন্ডুলকার যেসময় নিজের ক্যারিয়ারে ইতি টানছেন, তখনকার তুলনায় বর্তমান বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রসার ঘটেছে। টেস্ট ক্রিকেট, যার প্রতিদ্বন্দ্বিতা যা এখন মূলত ‘বিগ থ্রি’ অর্থাৎ ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ (ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সিরিজের কোনও সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতেও নেই), নিজের আবেদন অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলেছে। সেইসঙ্গে ৫০ ওভারের ক্রিকেটের দিন-দিন ক্লান্তিকর হয়ে ওঠা ক্রিকেটকে এক বিশেষ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

আর এখানে দাঁড়িয়েই ক্রিকেটের বিরাটের মতো এক চরিত্রকে মাঠে বিশেষ প্রয়োজন। ব্যাটিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে বোলার উইকেট পাওয়ার পর তাঁর সেই পরিচিত ‘ফিস্ট পাম্প’, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে সেই বিরাটীয় আচরণ, অধিনায়ক না থাকার পরেও মাঠের মধ্যে টিমের সমস্ত বিষয়ে তাঁর উপস্থিতি তাঁকে নিঃসন্দেহে এই খেলার সবচেয়ে বড় ‘শোম্যানে’ পরিণত করেছিল। এইসমস্ত কিছু বেশিরভাগ সময়েই তাঁর মধ্যে থেকে সেরা খেলাটা বের করে নিয়ে আসত, তবে এসবের কারণে তিনি বিতর্কেও জড়িয়েছেন। যার সর্বশেষ উদাহরণ অস্ট্রেলিয়া সিরিজেই অজি ওপেনার স্যাম কনস্টাসের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ।

‘অস্ট্রেলিয়ার না হলেও অনেকবেশি অস্ট্রেলীয়, যে সাদা পোশাকে কোনওসময় প্রতিপক্ষকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও রাজি ছিলেন না। একজন তীক্ষ্ণ যোদ্ধা, যে সবসময় নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত।’ কোহলির টেস্টকে আলবিদা জানানোর পরে গ্রেগ চ্যাপেলের বলা এই কথাগুলোই হয়তো কোহলির সম্বন্ধে কিছু বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। নিজের অধিনায়কত্বের শুরুর দিন থেকেই যিনি একটি বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি এবং তাঁর দল মাঠে নামবেন কেবল জেতার জন্য, ম্যাচ অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ করা কিংবা হেরে যাওয়া যেখানে কোনও অপশনই নয়।

শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা সংস্থা ‘বেসলাইন ভেঞ্চার্সের’ কো-ফাউন্ডার এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর তুহিন মিশ্র মনে করেন যে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া বিরাট কোহলি নামক ব্র্যান্ডে কোনও প্রভাবই ফেলবে না। তাঁর কথায়, ‘তেন্ডুলকার, কোহলি বা ধোনির মতো খেলোয়াড়রা কখনই খেলার একটি নির্দিষ্ট সংস্করণ থেকে অবসর নিলেও তাঁদের ব্র্যান্ড ভ্যালুর কোনও পরিবর্তন হবে না। বিশেষ করে কোহলি যখন এরপরেও বেশ কয়েক বছর ধরে ওয়ানডে এবং আইপিএল খেলার জন্য প্রাসঙ্গিক থাকবেন।’

কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে একটা প্রশ্ন সব জায়গায় খুব আলোচিত ছিল, সেটা হল ফ্যাব ফোর অর্থাৎ বিরাট, স্মিথ, রুট এবং উইলিয়ামসনের মধ্যে টেস্টে কে শ্রেষ্ঠ? তারপর থেকে বাকি তিনজন অবশ্য সেঞ্চুরির সংখ্যায় বিরাটকে (৩০) পেরিয়ে গিয়েছেন। বর্তমানে স্মিথ এবং রুট দুজনেরই সেঞ্চুরির সংখ্যা যেখানে ৩৬, সেখানে উইলিয়ামসন রয়েছেন ৩৩-এ। অথচ তারপরেও বিরাটের থেকে টেস্ট ক্রিকেটে সমর্থক কিংবা বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা এতটুকু কমেনি।

আর এখানেই যেই প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে উঠে আসে, তাহল বিরাট কোহলি, যিনি কিনা টেস্ট ক্রিকেটের এতবড় পূজারি ঠিক কোন জিনিসটা তাঁকে আটকাল অফস্ট্যাম্পের বাইরে কেরিয়ারের শুরু থেকেই তাঁর যে দুর্বলতা সেটাকে শোধরাতে? এপ্রসঙ্গে সম্মানিত ক্রিকেট লেখক এবং ‘ড্রিভেন : দ্য বিরাট কোহলি স্টোরি’-র রচয়িতা বিজয় লোকপল্লি বলেছেন, ‘কৈশোরকাল থেকেই আমি ওঁকে চিনি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে সে লাল বলের ক্রিকেটের একজন অত্যন্ত অনুগত সেবক ছিল। তবে, নিশ্চয়ই তাঁরমধ্যে কোনও অহংকার কাজ করেছিল, নাহলে নিজের সমস্যা সমাধানের জন্য বিরাট কেন সুনীল গাভাসকারের মতো কারোর শরণাপন্ন হলেন না সেটাই বড় আশ্চর্যের বিষয়।’

আর ঠিক এই দুঃখটা আমিও বয়ে বেড়াব। এরপর তাঁকে যতই একদিবসীয় ক্রিকেটে নীল জার্সি পরে কিংবা রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর জার্সি গায়ে মাঠে নামতে দেখি না কেন, সেটাই কখনও সাদা জার্সি আর ব্যাগি নীল টুপি মাথায় পরা বিরাটকে দেখার যে আনন্দ তার সঙ্গে মিলবে না।

(লেখক দুবাই গাল্ফ নিউজ ও কলকাতা টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ক্রীড়া সম্পাদক)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *