কৃষ্ণকুমার দাস: শুধুমাত্র অনুদানের ১ লাখ ১০ হাজার নয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজ্যের ৪৪ হাজার সর্বজনীন পুজো কমিটিগুলিকেই আরও বিপুল পরিমাণ লক্ষ্মীলাভের সুযোগ করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, বিদ্যুতে ৮০ শতাংশ ছাড়ের পাশাপাশি পুরসভা ও দমকলের ফি-মকুবের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় কমিটিগুলি এক ধাক্কায় ১০ হাজার থেকে ২/৩ লাখ টাকা পর্যন্ত সুবিধা পাবে বলে শুক্রবার পুজো কর্তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। বস্তুত এই কারণে কলকাতা থেকে রাজ্যের সমস্ত জেলা– কুমোরটুলি থিম শিল্পী, মণ্ডপ তৈরিতে ব্যস্ত ডেকারেটর শ্রমিক, মৃৎশিল্পী, ঢাকী-সহ সমস্ত শিল্পীরাই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় ব্যপক খুশি।
তাঁদের কথায়, দুর্গাপুজো এখন আর শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, রাজ্যের অর্থনীতিতে ৮০ হাজার কোটি টাকার টার্নওভারও। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স-কোচবিহার-মালদহ থেকে শুরু করে ঝাড়গ্রাম-পুরুলিয়া-বোলপুরের পুজোকমিটির কর্তারা শুক্রবার জানিয়েছেন, “ছোট ও মাঝারি পুজো আয়োজন আমাদের শুধু সহজ হল না, আরও জাঁকজমক করে বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব করার পথ সুগম করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।” এখানেই শেষ নয়, পুজোয় তিলোত্তমা কলকাতার পাশাপাশি রাজ্যজুড়ে যে বিপুল সংখ্যক হোর্ডিং লাগানো হয় সেখানেও বছর কয়েক আগে থেকে ‘বিজ্ঞাপন কর’ পুরোপুরি মকুব করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদি পুজোর সময় শহরজুড়ে লাগানো বিশাল মাপের সমস্ত হোর্ডিং থেকে কর আদায় করা হত তবে খাস কলকাতা পুরসভা কমপক্ষে ১০-১২ কোটি টাকা আয় করত। এই টাকার পুরোটাই কিন্তু ঘুরপথে পুজেকমিটিগুলির তহবিলেই যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুরসভার মেয়র তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
বাংলায় ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পর ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুজোয় কমিটিগুলিকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া শুরু করেন। করোনাকালে পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি এক ধাক্কায় তা বাড়িয়ে ৫০ হাজার করে দেন। এবছর অনুদান ১ লাখ ১০ হাজার ঘোষণায় দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে অর্থনীতি তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে বলে স্বীকার করছেন বঙ্গের অর্থনীতিবিদরাও। রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তারাও এদিন জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী সরকারের তরফে এই অনুদান ঘোষণার পর থেকেই বামজমানায় পুজো ঘিরে যে চাঁদার জুলুম দেখা যেত তা এখন কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঝালদা সীমান্তের পুরুলিয়ার তুম্বা-ঝালদা বোলতলা দুর্গাপুজো কমিটির সম্পাদক রবীন দেওঘরিয়ার কথায়, “আমাদের পুজোর বাজেট মাত্র দেড় লাখ। মুখ্যমন্ত্রী তো প্রায় সবটাই ব্যবস্থা করে দিলেন। চাঁদা তোলার কোনও দরকার হবে না।’’ মালদহ ইংলিশ বাজারের বালুচর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক অমিতাভ শেঠের সরল স্বীকারোক্তি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর পুজো বাজেট তৈরি করা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল। উনি শুধু অনুদান দেননি, পরোক্ষে আরও দু’লাখ টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।’’ কলকাতার অন্যতম সেরা পুজো ত্রিধারার কর্ণধার তথা রাজ্যের ডেপুটি চিফ হুইপ দেবাশীষ কুমার জানিয়েছেন, ‘‘কলকাতা তথা জেলার বহু ছোট পুজো এবছর মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান ঘোষণার পর বাজেট তৈরির মিটিং করছে। কলকাতার নামী বস্তি থেকে অন্ত্যজ গ্রামের পুজো, সবর্ত্রই মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্য ও সিদ্ধান্তে উপকৃত কয়েক কোটি উৎসবমুখর পুজো।’’ টালা বারোয়ারির থিম শিল্পী প্রশান্ত পাল থেকে শুরু করে কোচবিহারের ডেকারেটর শিল্পী, হুগলির চন্দননগরের আলোশিল্পীরাও বেজায় খুশী। বস্তুত, পুজো অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ায় রাজ্যের সব ধরনের শিল্পই সরকারি অনুদান ও সাহায্যকে স্বাগত জানাচ্ছে।
অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ‘বাংলার জিডিপি-র ৭/৮ শতাংশ শুধুমাত্র এই দুর্গাপুজো থেকেই বাড়বে।’ একথা মাথায় রেখে নেতাজি ইন্ডোরে পুজোকমিটিগুলির বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘দুর্গাপুজো শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতি ও অর্থনীতির অঙ্গ। পুজোর দিনগুলিতে শিল্প ও বাণিজ্যে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে এই উৎসবকে ঘিরে।’’ কলকাতায় ২৭৪২টি পুজো নিয়ে তৈরি পুজোর বৃহৎ সংগঠন ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের যুগ্ম সম্পাদক শাশ্বত বোস স্বীকার করেছেন, “ছোট পুজোগুলি যেমন মুখ্যমন্ত্রী অনুদানের দ্বারা সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে, তেমনই বিদ্যুতের ছাড়ে অনেকটাই লাভবান হয় বড় পুজোকমিটিগুলি।’’ শাশ্বতর কথায়, “আমাদের পুজো তো প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার বেশি ছাড় পায় বিদ্যুতে। এছাড়া অন্যান্য ছাড় মিলিয়ে দু’লাখ টাকা সুবিধা পাই।’’ ঝাড়গ্রামের জামবুনি সর্বজনীনের যুগ্ম সম্পাদক তপন পান্ডার কথায়, ‘‘আমাদের বাজেট ১০ লাখ, মুখ্যমন্ত্রী তো নানাভাবে দেড় লাখের দায়িত্ব নিয়েছেন। চিন্তা অনেকটাই কমে গেল।’’ বোলপুরের ভিকির বাঁধ সর্বজনীনের সম্পাদক দীপঙ্কর গুপ্ত ফোনে জানালেন, ‘‘বাঙালি-অবাঙালি মিলিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষ পুজোয় যুক্ত। কিন্তু চাঁদা দেওয়ার সামর্থ্য খুব কম মানুষের। সেই পুজোয় মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান ঈশ্বরের আশির্বাদ।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন