শিক্ষার খিদে বড় সাংঘাতিক

শিক্ষার খিদে বড় সাংঘাতিক

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  • লক্ষ্মীকান্ত কর্মকার (আর্দ্র)

এখন প্রায় যে কোনও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের কাছে করা  জনপ্রিয় প্রশ্ন হচ্ছে  ‘স্যর কী কী বিষয় পড়লে পরীক্ষায় কমন পাব?’  অর্থাৎ শিক্ষার্থী চায় তাকে মুখে খাবার তুলে দেওয়া হোক। এবং সে খাবার যাতে চিবোতে না হয় তার ব্যবস্থা করা হোক। সে শুধু কোনও প্রকারে গলাধঃকরণ করবে। নম্বর পাবে। ডিগ্রি অর্জন করবে। সে শুধু গলাধঃকরণে বিশ্বাসী কারণ তার খিদে রয়েছে। সে খিদে শিক্ষার খিদে নয়,  পুরোপুরি রূপে খাদ্যেরই খিদে। কারণ সমাজ তাকে শিখিয়েছে, সে পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলে ডিগ্রি অর্জন করতে পারবে না, আর ডিগ্রি না হলে চাকরির দিকে এগোবে কী করে সে? চাকরির মাধ্যমে পাবে পারিশ্রমিক। যা দিয়ে মিটবে খিদে। হ্যাঁ, একথা ঠিক খিদে মেটানোর এই পন্থা নতুন নয় কিংবা অন্যায়ও নয়। খাদ্যের খিদের জন্য শিক্ষা কাজ করে চলেছে অবিরত। তা করুক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে খাদ্যের খিদে শিক্ষার খিদেকে খুন করছে না তো? আলাদা করে শুধু শিক্ষার খিদের গুরুত্ব কতটা রয়েছে সমাজে? যদি থাকে তাহলে সেই খিদে নিবারণের উপায় হিসেবে সমাজ যে সমস্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে তা কি সত্যিই যথার্থ অর্থে শিক্ষার খিদে জাগানোর বা মেটানোর কাজ করছে? আমরা তখন না ভেবেই উত্তর দিতে পারব ‘হ্যাঁ’!  স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এগুলি তো সেজন্যই।

যদি তাই হয়। তাহলে যারাই এই সমস্ত পরিকাঠামো অর্থাৎ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোচ্ছে, তারা যথার্থ শিক্ষিত হয়েই বেরোনোর কথা। কিন্তু তা কতটা হচ্ছে? তাহলে একজন এমএ পাশ শিক্ষার্থীকে  বিড়াল দেখে মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখতাম না। যে শিক্ষা ক্লাস ওয়ান কিংবা ক্লাস টু-তে পাওয়ার কথা মাস্টার্স করেও শেখা হচ্ছে না কিছুই। কিংবা যাঁরা পড়াচ্ছেন তাঁদের মধ্যেও অনেককেই এইরকম কুসংস্কারের অন্ধকার ছায়া যে গ্রাস করেনি একথা নিশ্চিত করে আমরা বলতে পারি না।

আমরা ভাবি, যত বেশি শিক্ষার্থী পাশ করছে তত শিক্ষিত মানুষ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমরা একথা ভুলে যাই পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক জিনিস নয়। তার বড় প্রমাণ  রবীন্দ্রনাথ স্কুল-কলেজের গণ্ডি পাশ না করে সেই কবেই প্রমাণ করেছেন এগুলিতে না গিয়েও শিক্ষিত হওয়া যায়। যথার্থ রূপে শিক্ষিত হওয়া যায় বৈকি।

আসলে শিশুকাল থেকেই আমরা শিক্ষাকে দেখেছি খাদ্যের খিদে মেটানোর অস্ত্র হিসেবে। শিক্ষার খিদে আমাদের পায় না। তাই মেটানোরও প্রয়োজন পড়েনি। তাই ক্লাসের সিলেবাস কিংবা চাকরির সিলেবাসের বাইরে আমরা বই হাতে তুলিনি। তুলতে চাইনি। আর যেটুকু সিলেবাসের পড়ার জন্য প্রয়োজন পড়েছে সেটুকু শুধুমাত্র ওই পাশ করার তাগিদে। কেননা  শিক্ষক মহাশয়রাও তাঁদের নোট দেন। শিক্ষার্থী সেগুলি যত্নসহকারে গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করে। পরীক্ষা এলে একে একে তা উগরে দেয়। তারা পাশ করে। ভালো ফল করলে আমরা, সমাজ তাদের বাহবা দিই। তাদের আমরা খুব শিক্ষিত ছেলে কিংবা খুব ভালো ছেলে হিসেবে চিহ্নিত করি। শৈশব থেকেই এই স্মরণশক্তির উপর জোর আমাদের অভিভাবক কিংবা শিক্ষকরাও দিয়ে থাকেন।

আসলে স্মরণশক্তিকেই বুদ্ধিমত্তা হিসেবে ধরে নিই আমরা। ধরা যাক কেউ ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্যের নাম এবং তাদের রাজধানীর নাম  ঝরঝর করে বলতে পারে। আমরা অবাক হই এবং আমরা তাকে বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিমতী শিক্ষার্থী হিসেবে মেনে নিই। কিন্তু আসলে তা যে নয় সেটির দিকে আমাদের খেয়াল থাকে না। বিখ্যাত দার্শনিক আইএম টারম্যান-এর মনে – “The flexibility to hold on summary pondering” অর্থাৎ বিমূর্ত চিন্তা করার ক্ষমতাই হল বুদ্ধি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের সমাজে বিমূর্ত চিন্তাকে বাহবা দেওয়া হয়নি খুব বেশি। বরং  আমাদের  বাবা-মায়ের গর্বে বুক ফুলেফেঁপে ওঠে যদি আমরা ক্লাসে প্রথম হই। কিন্তু  সে তো গলাধঃকরণ বস্তুর  উগরে দেওয়ার ফল।

এভাবেই অন্তঃসারশূন্য মানুষ তৈরি হতে থাকে। সেদিকে আমাদের কারও খেয়াল থাকে না। তারপর তিনি আবার চাকরির জন্য গিলতে আরম্ভ করেন। আবার একে একে উগরে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সমাজ আবার তাঁকে বাহবা দেন। এবার তাঁকে একজন সফল মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

প্রভাতকুমারের দেবী গল্পে সমাজ যেমন একজন গৃহবধূকে দেবী বলতে বলতে সে নিজেকে শেষপর্যন্ত দেবী হিসেবেই মেনে নেয় এবং তার ফল হয় ভয়ানক। অন্ধত্বের জন্য দুটি প্রাণের মৃত্যু হয়। তেমনই তথাকথিত সফল মানুষটি নিজেকে সফল ও শিক্ষিত মানুষ ভাবতে থাকেন।

 এবং তিনি যে উপায়ে সফল হয়েছে ঠিক সেভাবেই পরবর্তী  প্রজন্মকে  সফল ও শিক্ষিত হতে পরামর্শ দেন। এই চক্র চলছে সেই কবে থেকেই। ফলে সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা তো দূর। সমাজে দুর্নীতি বাড়তে থাকে। কুসংস্কার বাড়তে থাকে। ফলত একুশ শতকে দাঁড়িয়েও আমরা করোনা তাড়ানোর জন্য দেশজুড়ে থালাবাটি বাজাতে থাকি।

প্রফুল্লচন্দ্র কিংবা রবীন্দ্রনাথের সময়ও এ সমস্যা ছিল। তাঁরা বলে গেছেন। লিখে গেছেন। আমাদের রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। সেগুলোও কিছু কিছু সিলেবাসের মধ্যেও পড়ি। কিন্তু শুধু পড়িই। অন্তরের চোখ, বিবেকের চোখ বন্ধ রেখেই পড়ি। আর এমনভাবে পড়ি বলেই শিখি না কিছুই। যেমন ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের ‘দেনা-পাওনা’ গল্প আমরা যারা পড়েছি, জানি, পণপ্রথার কী ভয়ানক রূপ। আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয় নিরুপমার দুর্দশায়। কিন্তু সে শিক্ষা আমরা নিজের জীবনে নিই না। কেননা নিজেকে সাজানোর জন্যই যে শিক্ষা তা ভুলে যাই। ফলত সেই নিরুপমার কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের বিয়ের সময় পণ নিয়ে নিই। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের সমাজে শিক্ষা বলতে স্কুল-কলেজকে বুঝি ; আবার স্কুল-কলেজের পাঠ্যতে যা পড়ি তা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাই না।

 যেমন আমরা প্রফুল্লচন্দ্রের ‘সত্য ও অসত্য’ প্রবন্ধে দেখেছি তিনি ক্লাসে সূর্যগ্রহণের কারণ বোঝালেন, শিক্ষার্থীরা তা লিখে পাশ করলেন। কিন্তু সত্যিই একদিন সূর্যগ্রহণ হলে সকলে মিলে কাঁসরঘণ্টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

এইসব ছবি এখনও কি পালটেছে? উত্তর হচ্ছে, না।  কাজেই, সমাজে যথার্থ শিক্ষিত মানুষ খুব বেশি তৈরি হচ্ছে না। একজন শিক্ষিত এবং একজন অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ফারাক খুব বেশি চোখে পড়ছে না। বরং এই তথাকথিত শিক্ষিত হওয়ার ফলে চালাকিটুকু শিখে নিচ্ছে। অশিক্ষিতের চেয়ে শিক্ষিত আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তারা নিজেদের শিক্ষিত ভেবে নিজের মতো করে একটা কিছু ভাবধারা তৈরি করছে। বর্তমানে সিলেবাসের নোট গলাধঃকরণের বাইরে যেটুকু পড়াশোনা করছে মানুষ সেটা ফেসবুকে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের টুকরো টুকরো কিছু ফরোয়ার্ডেড লেখা। সমাজমাধ্যমে আসা ভুল তথ্য কিংবা কু-যুক্তিই তাঁদের কাছে হয়ে উঠছে চিরসত্য।

আমাদের ভাবনার আকাশ ছোট হয়ে আসছে। শুধু খাদ্যের খিদের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু গলাধঃকরণ করেই আমরা সমাজমাধ্যমে রিল মিমসে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। আমরা পুতুলের মতো সেগুলিই শিখছি যা আমাদের শেখাতে চাইছে কেউ। সেই কেউ হতে পারে বাজার, পুঁজিপতি কিংবা রাষ্ট্র। আমাদের বোধের আকাশ বড় না হলে, আমরা স্বশিক্ষিত না হলে আমরা শুধু পণ্য হয়েই থাকব। আমাদের বই পড়া বাড়াতে হবে। বিমূর্ত চিন্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই হয়তো আমাদের চারপাশের আকাশ মুক্ত হবে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *