সেবন্তী ঘোষ
ঢাকার দুর্দান্ত স্কুল সেন্ট গ্রেগরিজে বালক অমর্ত্য সেনের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। ওই স্কুলের দুর্দান্ত রেজাল্টের গর্ব ও তৎজনিত অনুশাসনের কড়াকড়ি তিনি সহ্য করতে পারেননি। ঘটনাচক্রে তাঁকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে ভর্তি হতে হয়। পরে সুযোগ থাকলেও এই পুরোনো স্কুলে তিনি আর ফিরে আসেননি।
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর এই স্কুলের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক একটু কুণ্ঠার সঙ্গেই বলেন যে, ছাত্রদের দেখানোর জন্য পুরোনো খাতাপত্র খুঁজতে গিয়ে দেখছেন, সাঁইত্রিশজনের মধ্যে অমর্ত্য হয়েছেন একত্রিশ! তিনি এবারে বলেন, ইস্কুল ছাড়ার পরেই হয়তো অমর্ত্য ভালো ছাত্র হয়েছিলেন। অমর্ত্য এরপর আসল কথাটি লিখেছেন। তিনি ভালো ছাত্র তখনই হলেন যখন, ‘আমি ভালো ছাত্র কি না তা নিয়ে কেউ তোয়াক্কাই করত না।’
এই যে গল্পটির ভিতর শিক্ষণীয় বিষয়, বিদ্যাচর্চার সঙ্গে ভালোবাসার একটা গূঢ় সম্পর্ক আছে। একথা বলাই বাহুল্য, শিক্ষার অধিকার প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক ছাত্রদের উপকারে এসেছে। অন্যদিকে বাধ্যতার শিক্ষা, অনিচ্ছুকদের নোট গেলানো, কোচিংয়ের অঙ্কুশ, বেতের বাড়ির ভয় ও অভিভাবকদের রক্তচক্ষুতে ক্রমশ একটা কারখানায় পরিণত হয়েছে।
পেশার কারণে ইচ্ছুক ও অনিচ্ছুক ছাত্রদের সঙ্গে সবসময়ই আলাপ হয়। ইচ্ছুকরা খুব অল্প বয়স থেকেই যাকে বলে লক্ষ্যবিন্দুতে স্থির। তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমীরাও স্পষ্টভাবে জানে, তারা কী করবে। মাধ্যমিকে সব বিষয়ে নব্বই পেলেও তারা নিশ্চিত, ভবিষ্যতে তারা ছবি আঁকার স্কুলে যাবে। কেউ ইতিহাস পড়বে, সমুদ্রতট বিদ্যা শিখবে, কেউ সিনেমা বানাবে, মোবাইল ফোনের জন্য গেম তৈরি করবে, চকোলেট বা মোমবাতি প্রস্তুত করবে।
আর যারা ওই সেন্ট গ্রেগরি’র ভাষায় ‘শাইন’ করবে তারা চিরাচরিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদের পরীক্ষায় প্রবেশ করবে। এই ‘শাইন’ করার দলের সবাই যে স্বেচ্ছায় এই পেশাগুলোতে আসতে চায়, এমন নয়। সেই ১৫৬৪-তে জন্মানো গ্যালিলিওর বাবা অবধি ছেলের ভবিষ্যৎ বিষয়ে ভেবেছিলেন, সে ডাক্তারিতে যাক। সংসারের সুরাহা হবে। এখনও বঙ্গ মনোভূমিতে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
অনিশ্চিত পৃথিবীতে, ততোধিক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ছেলেমেয়েকে এগিয়ে দিতে অধিকাংশেরই বুক কাঁপে। তাই টেবিলের উলটোদিকে বিষণ্ণ মুখ যে ছেলেটি বলে, তাকে ডাক্তারি পড়তেই হবে কিন্তু সে চায় অ্যাথলেটিক্সে যেতে। মেয়েটি দুঃখিত গলায় বলে, সে চায় দিল্লিতে গিয়ে পড়াশোনা করতে, পরিবার বাড়ির মেয়েকে অত দূরে যেতে দেবে না। যে গানবাজনা করতে চায়, তাকে অন্তত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা ডিগ্রি রেখেই দিতে হবে। নাচতে চায় মেয়েটি, কিন্তু কষ্টের জয়েন্ট যখন ক্র্যাক করেছ, তখন ডাক্তারটা হয়েই নাও।
অবাক হয়ে ভাবি, পঁয়ত্রিশ বছর আগে পড়াতে আসার সময় থেকে এই গল্প বদলাল না! আর কবি বা লেখক? না, শুধুমাত্র এই কাজেই থেকে যাবে, আর অন্য কিছু করবে না, এমন কোনও আবদার নিয়ে আমার কাছে এতদিনেও কোনও ছেলেমেয়ে আসেনি।
পরিবর্তন যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কম। উত্তর পাওয়া গেছে দু’রকম। একটি কারণ এই যে, এর পিছনে অকল্পনীয় খাটনি আছে। দ্বিতীয় বিষয়টি আমাকে চমকে দেয়। আমাদের ধারণা, এই প্রজন্মের ছেলেপুলেরা রাজনীতি বিষয়ে উদাসীন বা অজ্ঞ। কিন্তু তারাই বলে, আগেকার সিভিল সার্ভেন্ট আর এখনকার প্রশাসনিক কর্তাদের মধ্যে তফাত আছে। যে কোনও শাসকদল তাদের অধীনস্থ সরকারি প্রশাসকদের সিভিলটা বাদ দিয়ে পরেরটুকু ভাবে!
মেয়েদের মধ্যে বিবাহ চিন্তা বাদ দিয়ে নিজে কিছু করার উদ্যোগ এখন প্রবল। বিবাহ যে ভবিষ্যতের মতোই অনিশ্চিত, সেটি তারা সম্যক উপলব্ধি করেছে। এখন অবধি যাদের কথা আলোচনা হল, তারা মোটামুটি বিদ্যাচর্চায় নিয়োজিত এবং ইচ্ছুকের দল। কোনও না কোনওভাবে তাদের পছন্দের বিষয় আছে। এর বাইরে একটা বিরাট দল আছে, যারা পড়াশোনাটাকে মন থেকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে এবং অপছন্দ করে। বাধ্যতার শিক্ষা তাদের আরও বিরক্ত করে তোলে। হয়তো আমাদের প্রচলিত বিদ্যালয়ের শিক্ষার যে প্যাটার্ন, তার মধ্যে তাদের ভালোবাসার বিষয়টি তারা খুঁজে পায় না। আবার এমনটাও হতে পারে, এমন কোনও অভিভাবক বা শিক্ষক তারা শৈশবে পায় না, যিনি কোনও একটি বিষয়ে তার আগ্রহ গড়ে তুলতে পেরেছেন।
একেক সময় মনে হয়, সর্বশিক্ষা অভিযান মাধ্যমিক অবধি ঠিক আছে, কিন্তু তারপরে প্রত্যেকের জন্য প্রচলিত পথে উচ্চশিক্ষার আদৌ কি কোনও সারবত্তা আছে? বিষয়টিকে ভালোবাসলাম না, ক্রমাগত নম্বর বাড়ানোর পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে গিয়ে, ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করলাম, এমন শিক্ষা শেষ অবধি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতেও সাফল্য এনে দেয় না। আর যখন এই সাফল্য এল না, তখন পরীক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি ধরলাম, সরকার ও রাষ্ট্রকে গালাগাল করলাম, লোক ধরার চেষ্টা করলাম এবং পোকা খাওয়া ব্যবস্থায় ঠিক তেমন লোক পেয়েও গেলাম, যিনি উপচার গ্রহণ করে সাদা খাতায় প্রার্থিত পদটি পাইয়ে দেবেন।
দুঃখের বিষয়, শিক্ষক নামে এমন অনেককে দেখেছি, যাঁরা এই চাকরিটি করেন মোটামুটি একটা বেতনের জন্য। পরবর্তীকালে বিদ্যাদানে অনিচ্ছুক বা বিরক্ত শিক্ষক, যার অপর পক্ষের কথা শোনা বা বোঝার ধৈর্য, সহানুভূতি কিছুই নেই, তিনি স্ফুটনোন্মুখ কুঁড়িটির ‘বস’ হয়ে বসলেন। তিনি নিজেকে প্রতিনিয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেলেন না। ইতিহাস পড়াতে গিয়ে নিজেই সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট থাকলেন। আচারবিচার কুসংস্কার গায়ে মেখে, দু’হাত ভরা আংটি রেখে, পৃথিবীর সব অশরীরী আধিদৈবিককে সঙ্গে নিয়ে, বিজ্ঞান পড়াতে বসলেন।
যে একতাল কাদার মতো নরম মনের শিক্ষার্থী, এঁদের গুরু মনে করল, তাদের জীবনে এঁদের প্রভাব চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেল। মনের জানলা খুলে দেওয়ার কাজটি করার কথা যাঁর, কষে দরজা-জানলা এঁটে দিলেন তিনি।
যে বিষয়টি স্কুল শিক্ষায় একেবারেই অবহেলিত হয়ে যায়, তা হল শিক্ষার আনন্দ পাওয়া। বিষয়টিকে ভালোবাসতে না পারলে, দীর্ঘ সময় ধরে তার অন্তরে প্রবেশ করার কোনও বাসনাই তৈরি হয় না শিক্ষার্থীর। মেনে নেওয়া যায়, যে নম্বরটি না পেলে তার উচ্চশিক্ষায় সমস্যা হবে। কিন্তু যেখানে নম্বরের বিরাট বড় কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, সেখানেও প্রতিবেশী, আত্মীয়বন্ধু, সমাজকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য অভিভাবকরা সন্তানের উপর বিপুল পরিমাণে চাপ তৈরি করেন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভয়াবহ ফলাফল আমরা রাজস্থানের কোটায় আত্মহত্যার ঘটনা থেকে দেখেই যাচ্ছি। শিক্ষক হিসেবে একেক সময় মনে হয়, ছাত্রছাত্রীরা নয়, অবুঝ অভিভাবকদেরই মাঝেমাঝে কাউন্সেলিং দরকার।
সরকারি ক্ষেত্রে যে শিক্ষকরা প্রতিযোগিতামূলক কঠিন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতেন, অধিকাংশ সরকারি স্কুলের নানা দৈন্যদশার মধ্যে তাঁরাই হাল ধরে থাকতেন। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার এক সরকারি স্কুলে স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ার পর এঁদের কাছ থেকে দেখেছিলাম। প্রান্তিক অবস্থানে থাকা ওই স্কুলটির ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেকের অভিভাবকরা নদীনির্ভর কাজ করতেন। এই শিক্ষকরাই ছাত্রছাত্রীদের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন। কোনও প্রাইভেট টিউশনের প্রশ্নই ছিল না। অধিকাংশ শিক্ষক গভীর মমতায় এবং কড়া ধমকে যতটা সম্ভব শৃঙ্খলা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই পরিষেবাটিও অধুনা ভেঙে যাওয়ার মুখে। ছাত্র না পাওয়ার অজুহাতে বহু স্কুল উঠে যাচ্ছে, আর যোগ্য শিক্ষকদের যে কী অবস্থা সে তো আমরা প্রতিনিয়ত দেখতেই পাচ্ছি।
স্কুল শিক্ষাকেই অবহেলা করার সময় মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল বক্তৃতায় নিজের সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তৈরি স্কুলের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে জানিয়েছিলেন। অমর্ত্য প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে আনন্দের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। এঁরা দুজনেই অনায়াসে উচ্চশিক্ষার প্রসার এবং তা নিয়ে কাজ করতে পারতেন। শিক্ষার গোড়ার কথাটি ভুললেই আগা নড়বড়ে হয়ে যায়, তা আমরা অধুনা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ধসে যাওয়া ফলাফল থেকেই বুঝতে পারছি।
(লেখক সাহিত্যিক ও শিক্ষক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)