- অভিষেক বোস
ফ্রেশ! একদম পিওর!
মাথাটা তুলে আবেশে চোখ বুজে আসছে যেন। চোখ খুলে বলল— এই হল খাঁটি জিনিস। নভেম্বরেই বলে রেখেছিলাম বুঝলি। এক্কেরে মাজদিয়ার সেরা জিনিস। গন্ধটা দ্যাখ একবার। ছেলেকে কথাটা বলেই, অবিকাশ মুখার্জি ছোট নাতিকে কোলে টেনে নিল। তারপর একটু আদর করে বলল— দাদুভাই তুমি খেয়েছ কখনও, নলেন গুড়?
মুখার্জির ছেলে অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে এসেছে। ডুসেলডর্ফে থাকে। তিন বছরের ছেলে আর বৌকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বৌ খড়্গপুরের প্রবাসী তামিল। তবে বাংলা বোঝে। বলতেও পারে। নাম সুজাতা। ইংরেজিতে লেখার সময় TH লেখে।
সুজাতা বলল— এখন তো ওখানেও পাওয়া যায় বাবা। সুপার মার্কেটে ফিফটিন ইউরোতে টিনড ক্যান পাওয়া যায়। ফ্রেশলি প্যাকড। আনটাচড। কোনও প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে না।
আলবাত পাওয়া যায়। তবে এ জিনিস না বৌমা। আজকাল তো শুনেছি, সারা বছর নলেন গুড়ের আইসক্রিমও পাওয়া যায়। একদিন মুখে দিয়ে দেখলাম। ছ্যা! খালি ফ্লেভার। বিস্বাদ খেতে।
এই তো মোড়ের মাথায় মিষ্টির দোকানটায় শীত পড়তে না পড়তেই, সন্ধ্যাবেলা থেকে ভিড় জমে যায়। নলেন গুড়ের রসগোল্লা, সন্দেশ। আজকালকার ছেলে ছোকরাদের জিভই নেই। ভালো খেজুরের রস নামার আগেই চিটে গুড়ের সঙ্গে সুগন্ধী মিশিয়ে এসব বিক্রি হচ্ছে। হাভাতের দল তাই কিনে খাচ্ছে।
শেষ ভালো নলেন গুড়ের মিষ্টি খেয়েছিলাম বছর দশেক আগে। চুঁচুড়া সন্ধ্যাশ্রীর মিষ্টি। সন্ধ্যাশ্রী চেনো তো বৌমা? হ্যান্ডক্র্যাফ্টেড হানি-ডিউ সন্দেশের আঁতুড়। সামান্য কয়েকজন লোকই এর স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। একদম গোনাগুনতি করে বানানো। প্রথম কামড়ে কিচ্ছুটি বুঝবে না। কেমন একটা বোকা বোকা ভাব করে, জিভের আশপাশে বসে থাকবে। যেই না ‘আন্ডার-এস্টিমেট’ করে দ্বিতীয় কামড়টা দিয়েছ, ব্যাস! ভেতর থেকে অমৃত বেরিয়ে আসবে। তারপর মুখের আশপাশে দিয়ে বইতে শুরু করবে। এবার পুরো জিভের খেলা, দাঁত তখন কমপ্লিট রেস্টে।
মুখার্জির গল্প শুনে ঘরসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। আজ সারাদিন গুড়ের গুণকীর্তন চলবে। বনেদি বড়লোক। ছেলে-বৌমা বাড়ি এসেছে। একটু হইচই তো হবেই।
জাঁকিয়ে শীত পড়েছে এবার। এসময় গৃহস্থের বাড়ির মানুষ, লেপের ওমটুকু কিছুতেই ছাড়তে চায় না। তবে নিতাই উঠে যায়। ভোরের আলো ঠিক করে ফোটার আগেই উঠে পড়ে নিতাই গাছি। বছরের এ সময়টাতে নিতাই মণ্ডল সিউলির কাজ করে। গাছে ছে’ দেওয়ার পর থেকেই ওর চোখে ঠিক করে ঘুম আসে না।
সিউলি হল গাছিদের সম্প্রদায়ের নাম। খেজুর গাছে উঠে, গাছ চেঁছে যারা রস নামিয়ে নিয়ে আসে তাদের সিউলি বলে।
দখিনা বাতাস যেদিন মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিক থেকে বইতে শুরু করেছিল, সেদিন থেকেই নিতাই আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে। বছরের এই দুই-তিন মাস সিউলির কাজ করলেও, নিতাই আসলে খেতমজুর। গেল বছরের ব্যাংকের টাকা মেটাতে পারেনি। এবছর মহাজনের কাছে মোটা টাকা দাদন নিয়ে নিতাই শীতের অপেক্ষা করছিল। হতচ্ছাড়া শীতটা এল দেরিতে।
নিতাইয়ের দ্বিতীয় পক্ষের বৌ মালতী মশারির ভেতর থেকেই আওয়াজ দিল— কী গো জ্বর গা’য়ে বেরোবে নাকি?
নিতাই মালতীকে ঘুমিয়ে থাকার ইশারা করে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল। আগের বোশেখে সুধাকে সাপে কাটার পর, পাড়াপড়শির একরকম চাপে পড়েই নিতাই মালতীকে বিয়ে করে এনেছিল। সুধাকে নিতাই ভুলতে পারেনি। কিন্তু মা হারা বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে মাস তিনেক আগে বিয়ে করেছে নিতাই।
বেরোবার আগে ছোট মেয়ে লক্ষ্মীর দিকে একবার চেয়ে দেখল। মেয়েটা এখনও রোজ রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কতই বা বয়স? সদ্য পাঁচ। আর বড়টা আট। মালতী অযত্ন করে না ওদের। তবে নিজের সন্তান নিজেরই হয়।
না আর দাঁড়ালে চলে না। মহাজনের টাকা শোধ করতে না পারলে বাচ্চাগুলোর মুখে কী তুলে দেবে। ছ’-সাত হাঁড়ি রস জ্বাল দিলে আধা কেজি গুড় হয়। ভোরের আলো ফোটার আগেই রস নামিয়ে আনতে হয়। যত ঠান্ডা পড়বে তত ভালো গুড় হবে। গাঁয়ের ছেলে ছোকরাগুলো তাড়ির লোভে ঘুরে বেড়ায়। নিতাই বারবার ফিরে আসে জমির দিকে। কে কখন হাঁড়ি খুলে নিয়ে চলে যায়!
রোজ রোজ গাছ চাঁছলে গুড় ভালো হয় না। তাই সপ্তাহে বার তিনেক রস নামায়। আর তিনদিন গাছকে বিশ্রাম দেয়। তিনদিন পর প্রথম দিনের রসকে বলে ‘জিরেন গুড়’। তৃতীয় দিনের রস হল ‘তে-কাট’।
কাঁটার থেকে গা বাঁচিয়ে গাছে উঠে জঞ্জাল সাফ করে ‘ছে’ দিতে হয়। এত কষ্ট করে হাঁড়ি বেঁধে রসে কুয়াশা শিশির পড়লে রসের আর কোনও গুণ থাকে না। এসব কিছু মাথায় রাখতে হয়।
জমাট কুয়াশার মধ্যেই ওর মতো কয়েকজন মাঠের দিকে রওনা হয়েছে। জমিতে আসতে আসতে আকাশ ফর্সা হয়ে সকাল হল। তবে এখনও সূর্যের দেখা নেই। মাথায় ফেটি বেঁধে, কোমরে প্যাঁচানো নারকেল গাছা জড়িয়ে নিতাই গাছে উঠতে শুরু করল। কোমরে হাঁসুয়া বাঁধা আছে। খালি পাত্রটা বেঁধে, রসে ভরা হাঁড়িটা নামিয়ে আনবে।
তরতর করে উপরে উঠে গেল নিতাই। এ কাজ কোন ছোটবেলা থেকে করছে। ষোলো-সতেরো হবে হয়তো তখন। বাবার কাছেই শিখেছে গাছির কাজ। প্রথম প্রথম গা হাত পা ছড়ে যেত। নুন ছাল উঠে গিয়ে এমন জ্বালা করত, বিছানায় শুতে পারত না। তারপর একদিন গাছটাকে এমন করে জড়িয়ে ধরেছিল, যেন প্রথম বয়সের প্রেয়সী।
আজকেও অনায়াসে উঠে এসেছিল। কিন্তু উপরে উঠেই মাথাটা হঠাৎ ঝিম মেরে উঠল। দু’দিন থেকেই গা’টা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে। হাঁড়িটা নামাতে গিয়ে নিতাই চোখে অন্ধকার দেখল। আর কিছু মনে নেই।
নিতাই সিউলির অসার দেহটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছিল। রসভর্তি ভাঙা হাঁড়িটা পাশেই পড়ে ছিল। মুখভর্তি রক্তের সঙ্গে তাজা খেজুর রস মিশে গিয়ে বিস্বাদ ঠেকল। নিষ্প্রভ চোখ দুটো একবার মহাজনের মুখ মনে করল। একবার মালতীর। বায়োস্কোপের মতো চোখের সামনে বাচ্চাগুলোর মুখ ভেসে আসছিল। সুধার মুখটা ভেসে উঠতেই চোখটা একেবারে বুজে গেল।
অবিকাশ মুখার্জি, বনেদি বড়লোক। এই শীতে ভালো নলেন গুড় না আনলে মুখে রোচে না। মুখার্জির ছোট ছেলে জার্মানি থেকে এসেছে। বৌমা বলছিল— খাস ইউরোপের বাজারেও এখন নলেন গুড়ের রমরমা। ওদেশেও এদেশের মতো ডিসেম্বরে লোকজন ফেসবুকে নলেন গুড়ের ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস আপলোড করে। পনেরো পাউন্ডে টিনড গুড় পাওয়া যায়। একদম পিওর। ফ্রেশলি প্যাকড। আনটাচড!