শাস্তি নাকি শেষপর্যন্ত শাপে বর ভারতের 

শাস্তি নাকি শেষপর্যন্ত শাপে বর ভারতের 

ব্লগ/BLOG
Spread the love


 

  • চিরঞ্জীব রায়

ব্যক্তিটির নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। মনোবিদরা তাঁর আচার-আচরণ, কার্যকলাপ, কথাবার্তা বিচার করে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তিনি নিজেকে মানবশ্রেষ্ঠ ভাবেন। তিনি কর্তৃত্বে বিশ্বাসী, আত্মকেন্দ্রিক, একগুঁয়ে এবং তাঁর মধ্যে মানবিক উষ্ণতা বা আন্তরিকতার লেশমাত্র নেই। এমন একজন ব্যক্তিত্ব শুল্ককে বাণিজ্যের অঙ্গ নয়, বিশ্ব শাসনের হাতিয়ার করে তুলেছেন। তাঁর ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ থামানোর দাবি নয়াদিল্লি মানেনি। তার হুমকি থোড়াই পরোয়া করে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করেনি।

এই অবজ্ঞা সহ্য হয়নি মার্কিন প্রেসিডেন্টের। তাই মাত্র এক বছর আগেও ভারতের পণ্যের আমেরিকায় আমদানি শুল্কের অঙ্ক ছিল ৩ শতাংশ, সেটা বাড়িয়ে করে দেওয়া হল ৫০ শতাংশ। ভারতের বাণিজ্যের ইতিহাসে এত বড় মাত্রার বিপর্যয় আগে ঘটেনি। ২০২৪ সালে আমেরিকায় ৯১২০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ভারত। এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৬০০০ কোটি ডলারের পণ্য ৫০ শতাংশ শুল্কের শিকার হবে।

যার ভীষণ প্রভাব পড়বে পোশাক, টেক্সটাইলস, জুয়েলারি, কার্পেট, আসবাব, চিংড়ি সমেত নানা শ্রম নিবিড় শিল্পে। ৫০ শতাংশ শুল্ক অর্থাৎ, ভারতের বোঝা চিন (৩০ শতাংশ), ভিয়েতনাম (২০ শতাংশ) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের (১৫ শতাংশ) থেকে অনেকটা বেড়ে গেল। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এই নতুন শুল্ক আগে থেকে ধার্যের সঙ্গে যোগ হবে। যেমন, জামার ক্ষেত্রে শুল্ক ছিল ১২ শতাংশ, সেটা বেড়ে হবে ৬২ শতাংশ।

অথচ, চিন বা ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের শুল্ক হবে অনেক কম এবং ভারত রপ্তানির ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের হিসেবে এর পরিণতি হল, ২০২৬ আর্থিক বর্ষে আমেরিকায় ভারতের রপ্তানির অঙ্ক কমে ৯০০০ থেকে ৫০০০ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। শ্রম নিবিড় শিল্পে ভারতের আন্তর্জাতিক রপ্তানির ৩০ শতাংশ যায় আমেরিকায়। সেটা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে কম শুল্কের সুবিধাভোগী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ধাক্কা খেতে হতে পারে ভারতকে। যেমন, চিংড়ির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ শুল্কের জেরে ভারতীয় মৎস্যজীবী ও কারখানাগুলিকে পিছনে ফেলে দেবে ইকুয়েডর বা ভিয়েতনামের মতো দেশ। এদেশ থেকে আমেরিকায় বছরে ১০০০ কোটি ডলারের সোনাদানা, হিরে রপ্তানি হয়। আমেরিকার আমদানির ৪০ শতাংশ সেটা। ট্রাম্পের ফতোয়ায় ক্ষতি হবে সেক্ষেত্রেও। আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে, সুরাট, মুম্বই, জয়পুরের মতো শহরে অনেকে এর ফলে কর্মহীন হবেন।

আমেরিকার আমদানির ৩৫ শতাংশ টেক্সটাইলস এবং পোশাক ভারতের। যার মূল্য প্রায় ১১০০ কোটি ডলার। ৬৪ শতাংশ শুল্কের বোঝা নিয়ে সংকটে পড়বে সেই শিল্প। মাঝখান থেকে লাভ হবে বাংলাদেশ বা মেক্সিকোর মতো দেশের। কার্পেট, হস্তশিল্প, আসবাব, এমনকি বাসমতী চাল এবং বিভিন্ন মশলাও শুল্কের কোপে পড়েছে। রপ্তানিতে ভারত দশকের পর দশক যে ক্রমাগত বৃদ্ধির ঢেউয়ে সওয়ার ছিল, সেই অগ্রগতি থমকে যাবে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের রপ্তানির সম্ভার সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধির অনুকূল নয়। তাই বিপর্যয় যতটা গুরুতর, ভারতের প্রচেষ্টা ততটাই ব্যাপক হতে হবে। মার্কিন বাজারে রপ্তানিতে অসম প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করতে পরিকাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন হবে। লাভের অঙ্ক কমবে বলে পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে, শ্রম আইনের সরলীকরণ প্রয়োজন হবে। দেশে উৎপাদনশীলতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।

নিম্ন ও মাঝারি মাপের দেশীয় উৎপাদনের সম্ভাবনাযুক্ত ক্ষেত্রগুলিতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি আমদানি করতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আইআইটি, বিটস, সিএসআইআর এবং বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সর্বোত্তম উপযোগিতাকে ব্যবহার করতে হবে। দেশের বিশাল চাহিদা মেটাতে ভারতকে অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভর করতেই হয়। অপচয় রুখে এর ব্যবহার খানিক নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও আমদানির চাপ কমে।

ইলেক্ট্রনিক্স, বিভিন্ন উচ্চপ্রযুক্তির সরঞ্জাম, ওষুধপত্র, টেক্সটাইলস, অটোমোবাইলস ইত্যাদি আমদানি করে থাকে ভারত। শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে জৈব ও অজৈব রাসায়নিক এবং সার আমদানির প্রয়োজন পড়ে। লোহা ও ইস্পাত, প্লাস্টিক ইত্যাদির চাহিদা দেশীয় উৎপাদনে মেটে না। বিমান এবং মহাকাশযানের যন্ত্রাংশও আমদানি করতে হয়। রপ্তানি ধাক্কা খাওয়ার সন্ধিক্ষণে এসব ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতা বাড়িয়ে আমদানি খরচ কমাতে হবে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, রপ্তানিকারকদের পাশে দাঁড়ানো। এমএসএমই অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য বাজেট সহায়তার মাধ্যমে শ্রম নিবিড় ক্ষেত্রে অর্থসংস্থান বাড়াতে হবে। তাতে অর্থ জোগানের খরচ এবং তার জেরে উৎপাদনের খরচ কমবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রপ্তানির বিকল্প ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আরও সক্রিয় করে তুলতে হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী রপ্তানি আলোচনাও ত্বরান্বিত করতে হবে। এর পাশাপাশি, রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারি আইনকানুনের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে ন্যাশনাল ট্রেড নেটওয়ার্ক-এর বন্দোবস্ত করা জরুরি, যাতে একই মঞ্চ থেকে সব সমস্যার দ্রুত সমাধান হয়। সরকার ইতিমধ্যে জিএসটি-র হার কমিয়েছে। নজর রাখা হচ্ছে যাতে ক্রেতারা ২২ সেপ্টেম্বর থেকে পরিবর্তিত জিএসটি-র সুবিধা পান।

কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের আশা, জিএসটি-র হার কমলে দেশীয় বাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়বে এবং তাতে মার্কিন খামখেয়ালিপনা খানিকটা হলেও মোকাবিলা করা যাবে। আশার কথা হল, আমেরিকা ছাড়া অন্যান্য দেশে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির হার ঊর্ধ্বমুখী। ২০২৫ সালের তুলনায় ২০২৬ সালে পাঁচ শতাংশ বেড়ে রপ্তানির অঙ্ক ৩৫ হাজার কোটি ডলার থেকে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা।

পরিষেবা রপ্তানির চিত্রটা আরও আশাব্যঞ্জক। তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরিষেবা রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা ১০ শতাংশ। অর্থাৎ পণ্য ও পরিষেবা রপ্তানির অঙ্ক  ৮২ হাজার কোটি ডলার থেকে বেড়ে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি ডলার ছুঁতে পারে। সেটা হলে ট্রাম্প সৃষ্ট ঝড়ঝঞ্ঝার পরেও ভারতের রপ্তানি ২.৩ শতাংশ বাড়বে। তাছাড়া আগের মনোভাব বদলে চিনা লগ্নির দরজা খুলতে পারে ভারত।

নীতিহীন শুল্কনীতি নিয়ে আমেরিকা ও তার প্রেসিডেন্ট এখন ঘরে-বাইরে, কূটনৈতিক মহল থেকে সংবাদমাধ্যম সর্বত্র যথেষ্ট চাপে। খোদ মার্কিনিরাই ভারত থেকে যাওয়া ওষুধ, পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, যানবাহনের যন্ত্রপাতি ইত্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। গোটা পৃথিবীই ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনা, বিশেষ করে ভারতের ক্ষেত্রে শুল্ককে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করার বিপক্ষে। মার্কিন আদালতই বহু ক্ষেত্রে বর্ধিত শুল্ক অবৈধ হিসাবে রায় দিয়েছে।

(লেখক প্রাবন্ধিক)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *