বিশ্বদীপ দে: দলাই লামা। সম্প্রতি পেরিয়েছেন ৯০তম জন্মদিন। তাঁর উত্তরাধিকারী তিনিই বাছবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন নবতিপর ধর্মগুরু। যা নাপসন্দ চিনের। এদিকে দলাই লামার পাশে রয়েছে ভারত। স্বাভাবিক ভাবেই যাঁরা তিব্বত ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে ভারত-চিন দ্বন্দ্বের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন, তাঁদের মনে প্রশ্নটা আসবেই- এখানে ভারত ও চিনের কী ভূমিকা? একজন ধর্মগুরুর উত্তরাধিকারী বেছে নেওয়ায় দু’টি রাষ্ট্রের কী ভূমিকা থাকতে পারে?
আসলে ভারত ও চিনের মধ্যে হিমালয়ের বৌদ্ধধর্মের নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার এই প্রবণতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন দলাই লামা। এটা কিন্তু কেবলই বাণিজ্য কিংবা ভূখণ্ড দখলের চেনা কোনও কূটনৈতিক লড়াই নয়। এখানে কেন্দ্রবিন্দুতে ধর্ম। চিন চায় তিব্বতের দুর্বল পরিকাঠামোর সুযোগে ধর্মীয় দিক থেকে এখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করতে। সোজা কথায় প্রভাব বিস্তার করে রাখতে। অর্থাৎ ‘দাদাগিরি’ করতে। তিব্বতে যত বেশি দৃঢ় হবে চিনের মুষ্ঠি, ততই নয়াদিল্লির উদ্বেগ বাড়বে। কাজেই আর সেটা হতে দিতে চায় না ভারত।
অথচ ভেবে দেখলে বৌদ্ধধর্ম অহিংসার কথাই তো বলে এসেছে। কিন্তু এই ধর্মই কী করে যেন ভূ-রাজনৈতিক দাবাখেলার এক বোর্ড করে তুলেছে তিব্বতকে। ধ্যান ও ধর্মীয় শিক্ষার আকর হিসেবে পরিচিত মনাস্ট্রিগুলোই যেন জাতীয়তাবাদী খেলার ‘পাওয়ার গেম’-এর আখড়া। লাদাখ, তাওয়াং এমনকী নির্জন ভুটান পর্যন্ত বৌদ্ধ সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমানতা এক বৃহত্তর কৌশলের অংশ। কিন্তু এর কেন্দ্রে নিশ্চিত ভাবেই তিব্বত ও দলাই লামা।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ গুরু দলাই লামাকে বেছে নেওয়া শুরু হয় ১৩৯১ সালে। অর্থাৎ ছশো বছরেরও বেশি সময়ের আগে। কিন্তু সোনম গেতসোর সময় দলাই লামার পদে বসার সময় থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতিকরণ হতে থাকে সেই পদটির। কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি যে সেই প্রথম। তারপর যত সময় এগিয়েছে তত রাজনীতি ধীরে ধীরে তার অবস্থান মজবুত করেছে। বিংশ শতাব্দীতে এসে তা আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। বিশেষত দ্বিতীয়ার্ধে। সেই সময় কার্যতই টগবগিয়ে ফুটছে তিব্বত। ১৯৫১ সালে ‘সতেরো দফার চুক্তি’ হয়েছিল, যার অন্যতম শর্তই ছিল তিব্বতের ধর্মীয় স্বশাসন। তার আগে ১৯৫০ সালেই তিব্বত চলে গিয়েছে চিনের দখলে। কাজেই বোঝা যাচ্ছিল এই ‘স্বশাসন’ আসলে একটা ‘বিভ্রম’ মাত্র। ফলে চুক্তি ঘিরে একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েই ছিল। লাসায় টহল দিচ্ছিল চিনা সৈন্যরা। লাসায় টহল দিচ্ছিল চিনা সৈন্যরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সমঝোতায় আসতে চাইছিলেন দলাই লামা। কিন্তু সব চেষ্টাই জলে গেল। ১৯৫৯ সালে পরিস্থিতি কার্যতই ফুটন্ত হয়ে ওঠে। তিব্বতের মানুষ ভয় পাচ্ছিলেন। তাঁদের ভয় ছিল হয়তো তাঁদের ধর্মীয় নেতাকে অপহরণ করা হবে। হয়তো খুনই করে ফেলবে চিন! ততদিনে চিনের মুষ্ঠি ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠেছে তিব্বতে। এরপরই দলাই লামার সিদ্ধান্ত ছেড়ে চলে যেতে হবে তিব্বত। দু’সপ্তাহ লেগেছিল ভারতে পৌঁছতে। ৩১ মার্চ হিমাচল প্রদেশের মধ্যে দিয়েই এদেশে প্রবেশ করেন দলাই লামা। তাঁকে গ্রহণ করেন অসম রাইফেলসের সেনারা। পিছনে পড়ে রইল তাঁর জন্মভূমি। চিনের চক্রান্তে আর যেখানে ফিরে যাওয়া হয়নি তাঁর।
এরপর থেকেই তিব্বতের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত করতে শুরু করে চিন। প্রথমেই লামাদের আরও বেশি করে প্রান্তিক করে দেওয়া হতে থাকে। তাঁরা যেন কোনওভাবেই রাষ্ট্রের বিপক্ষে মুখ খুলতে না পারে তা নিশ্চিত করা হতে থাকে। বহু বৌদ্ধ সংগঠনকে সরাসরি একরকম দখলই করে ফেলে বেজিং। মনাস্ট্রিগুলির কার্যক্রম অত্যন্ত নিবিড় ভাবে নজরে রাখা শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক দশকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ২০০৭ সালে রীতিমতো আইন নির্মাণ করে চিন জানিয়ে দেয়, তারা স্বীকৃতি না দিলে এখানে কোনও বৌদ্ধ ধর্মগুরুই স্বীকৃত বলে গণ্য হবেন না।
উলটো দিকে দলাই লামা ভারতে প্রবেশের পরও কিন্তু নয়াদিল্লি এর কোনও অনৈতিক ফায়দা তোলার দিকে যায়নি। কিন্তু তাতে উলটে চিনের বজ্রমুষ্ঠিই শক্ত হয়েছে তিব্বতে। কার্যতই বাধ্য হয়ে গত দশক থেকে ধীরে ধীরে ভারত তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় স্বদেশ দর্শন প্রকল্পের। যা ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের একটি প্রকল্প। এদেশের পর্যটনের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তোলাই যে প্রকল্পের লক্ষ্য। কুশীনগর, সারনাথ ও গয়ার মতো ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলাও যারই একটি অংশ। পাশাপাশি বুদ্ধ যে এদেশেই জন্মেছিলেন, তিনি যে আদপে ভারতীয়- সেকথাও নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার মতো কৌশল নিয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু এই ধরনের ‘নরম’ পদক্ষেপের বেশি যায়নি নয়াদিল্লি। অন্যদিকে চিন রীতিমতো রাষ্ট্রশক্তি জোরাল করেছে বৌদ্ধধর্মের উপরে। বলাই বাহুল্য, ‘পাখির চোখ’ সেক্ষেত্রে তিব্বতই। ফলে প্রসঙ্গতই এসে পড়ছে দলাই লামার নাম।
বর্তমান দলাই লামা জানিয়েছেন, তিনিই বেছে নেবেন পঞ্চদশতম ধর্মগুরু। সম্প্রতি ধরমশালায় এক ধর্মসম্মেলনে তিনি এমন ঘোষণা করেছেন। আর এতেই প্রমাদ গুনেছে চিন। তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ (এমনকী ‘সন্ন্যাসীর বেশে নেকড়ে’) তোপ দেগে বেজিংয়ের সাফ কথা, তাদের দেশের ধর্মাচরণ থেকে ঐতিহাসিক প্রথা মেনেই বাছকে হবে উত্তরাধিকারী। সোজা কথায় দলাই লামার মনোনয়নের জন্য তাদের অনুমোদন লাগবে। এই দাবি নস্যাৎ করে দেয় নয়াদিল্লি। কেন্দ্রের সাফ কথা, নির্ধারিত ট্রাস্ট ছাড়া অন্য কারও এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই। এহেন মন্তব্যের পরই এবার পালটা আক্রমণ করে বেজিং। তাদের দাবি, নয়াদিল্লি যেন চিনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলায়। এতে দুই দেশের সম্পর্কেই প্রভাব পড়বে। জবাবে চুপ থাকেনি ভারতও। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেন, ”যাঁরা দলাই লামার অনুসারী, তাঁরা সকলেই জানেন, নির্ধারিত সংগঠনই তাঁর উত্তরসূরি বাছবেন। তিনি এবং সেই ট্রাস্ট ছাড়া অন্য আর কারও এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই।” এই ‘অন্য কারও’ বলতে তিনি কাদের কথা বলছেন তা সহজেই বোঝা যায়।
যাই হোক, পরিস্থিতি যা তাতে কিন্তু ‘অ্যাডভান্টেজ’ ভারত। কেননা বৌদ্ধধর্মের ‘প্রাণভোমরা’ রয়েছেন এদেশেই। পরবর্তী দলাই লামাও ভারত থেকেই বাছা হবে। ফলে দলাই লামার প্রতি চিনের রক্তচক্ষু ভারতের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠছে। চিনের আগ্রাসনের ছবিতে তুলে ধরতে যাকে নিশ্চিত ভাবেই কাজে লাগাবে ভারত। তাই অকারণ রাষ্ট্রশক্তির নিষ্পেষণ দেখিয়েও চিনকে পিছুই হটতে হবে। বিশ্বের মঞ্চে ভারতের অবস্থান বাকিদের সমর্থন পাবে এই বিষয়ে। একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন