শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গৃহদেবতা    

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গৃহদেবতা    

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


  •  পূর্বা সেনগুপ্ত

উনবিংশ শতাব্দীর নারীদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে যিনি উপন্যাস রচনা কিরেছিলেন। যাঁর কলমে অভাগীর স্বর্গলাভের ইচ্ছা যে একটা কেবল ফ্যান্টাসি তা মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিল সেই মানুষটি অবশ্যই কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ন্যায় আর অন্যায়ের সূক্ষ্ম ফারাক যাঁর জীবনবোধের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর গৃহে কোন দেবতা পূজিত হতেন তা আমাদের জানার ইচ্ছা স্বাভাবিক। সেই মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা গৃহদেবতার খোঁজে এই কথাসাহিত্যিকের জীবনে প্রবেশ করতে চেষ্টা করব।

হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো অবস্থাপন্ন পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি। এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। তবে, এই পরিবারের আদি বাসস্থান হুগলিতে ছিল না, তাঁরা উত্তর চব্বিশ পরগনার কাঁচড়াপাড়া অঞ্চলে মামুদপুর নামে একটি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় চাকরিসূত্রে দেবানন্দপুরে কিছুদিন বাস করেছিলেন। এর পরবর্তী পর্যায়ে চট্টোপাধ্যায় পরিবার বাংলা ত্যাগ করে চলে যান বিহারের ভাগলপুরে। পাঁচজন ভাইবোনের বিরাট সংসার। পিতা মতিলাল সেই সংসার চালাতে অপারগ, কারণ তাঁর জীবিকা খুব স্থায়ী ছিল না। তাই মাতা ভুবনমোহিনী দেবী পিতৃগৃহ ভাগলপুরেই বসবাস করতেন। শরৎচন্দ্রের শিক্ষা শুরু হয়েছিল দেবানন্দপুরেই। কিন্তু সেখানে তিনি বেশিদিন স্কুলে যেতে পারেননি। ভাগলপুরেই তাঁর শিক্ষাজীবনের বেশিরভাগ সময় অতিক্রান্ত হয়। তবে এন্ট্রাস দেওয়ার আগে তিনি আবার দেবানন্দপুরে ফিরে এসেছিলেন।

 তাঁর জীবনের প্রথম পর্যায়ে, যখন তিনি জন্মস্থান দেবানন্দপুরে ছিলেন বা ভাগলপুরে বাস করেছেন তখন তাঁর জীবনে এতটা অনিশ্চয়তা ছিল যে সেই পরিবারে কোনও গৃহদেবতার অধিষ্ঠানের কথা চিন্তা করা যায় না। কারণ, পরগৃহে যাঁদের বাস তাঁদের নিজস্ব গৃহদেবতার পূজার্চনা করা বিলাসিতা মাত্র৷ মাতুল গৃহে কোনও দেবতা পূজিত হতেন কি না আমরা তা খোঁজ করিনি।

শরৎচন্দ্রের জীবনের সঙ্গে বোহেমিয়ান শব্দটি যেন একেবারে মানানসই। জীবন তাঁকে এত জায়গায় ঘুরিয়েছে, এত অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে যা বর্ণনা করলে আরেকটি সাহিত্যেকর্মের সৃষ্টি হবে। তিনি রেঙ্গুন থেকে বাংলায় যখন ফিরে এলেন তখন শেষ জীবনটি অতিবাহিত করার জন্য তিনি কিন্তু দেবানন্দপুরে গেলেন না। তিনি প্রথমে কিছুদিন হাওড়ার বাজে শিবপুরে ভাড়াবাড়িতে বসবাস করলেন, তারপর ব্যাতাইতলা অঞ্চলে একটা বাড়ি কিনেছিলেন। সম্ভবত শিবপুরের সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারগুলি তাঁকে একঘরে করেছিলেন। এই মনঃকষ্টের সময় তিনি একবার তাঁর বোনের শ্বশুরবাড়ি পানিত্রাসে যান, অঞ্চলটি তাঁর পছন্দ হয়। পানিত্রাস অঞ্চলের দেউলটি স্টেশন থেকে আরও চার-পাঁচ কিলোমিটার গেলে সামতাবেড়ে নামে এক গ্রাম আছে। সেখানে  একেবারে রূপনারায়ণ নদীর কূলে একটি জমি কিনে বাড়ি তৈরি করলেন। জগৎ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন স্থানে, এই বাড়িতেই তিনি জীবনের শেষ বারোটা বছর বসবাস করেছেন। গ্রামটির নাম সামতাবেড়ে হলেও আমরা সাধারণের মতো দেউলটি বলেই চিহ্নিত করব। আমাদের গৃহদেবতার আলোচনায় এই দেউলটির বাড়িটিই গুরুত্বপূর্ণ।

শরৎচন্দ্র যখন এই সামতাবেড়ের বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন তখন তিনি সাহিত্যিক রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।  শুধু তাই নয়, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি গভীরভাবে যুক্ত হয়ে যান। তাঁর সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাশের পরিচয়ের পর তা কংগ্রেস গঠন ও পরিচালনা বিষয়ে গভীর নির্ভরতার সম্বন্ধে পরিণত হয়। শরৎচন্দ্র যে জেলায় বাস করতেন সেই হাওড়া জেলার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদটি অলংকৃত করেছিলেন।  এরই সঙ্গে তিনি হ্যোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মাধ্যমে গরিব মানুষের চিকিৎসা করাও শুরু করেন। দেউলটির এই বাড়িতে বিপ্লবী চিত্তরঞ্জন দাশ তো এসেছিলেনই সঙ্গে তার ভাবশিষ্য সুভাসচন্দ্র বসুও বেশ কয়েকবার এই গৃহে এসেছিলেন। এছাড়া রাসবিহারী বসু, বাঘা যতীন, বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায় রাতের অন্ধকারে নৌকাযোগে এই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই বাড়িতে নাকি বসত গোপন বৈঠক। বোঝা যায় নবগঠিত কংগ্রেসের যেন একটি কেন্দ্রালয়ে পরিণত হয়েছিল এই গৃহ। তার সঙ্গে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আনাগোনা। বাড়িতে তাদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য পৃথক দরজাও দেখতে পাওয়া যায়।

বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ তখন উত্তপ্ত। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় চিত্তরঞ্জন দাশকে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে এমন একটা আঁচ তিনি পেয়েছিলেন। পরে তিনি জেলে গিয়েছিলেনও। ঠিক সেই অবস্থায় তিনি একটি শ্বেতপাথরের রাধা আর কৃষ্ণের যুগল বিগ্রহকে দিয়ে গেলেন শরৎচন্দ্রের কাছে। সেই থেকে সাহিত্যিকের গৃহে প্রতিষ্ঠিত হলেন গৃহদেবতা।

এখানে কিছু প্রশ্ন মনে দেখা দেয়, প্রথমত, এই রাধাকৃষ্ণ মূর্তি কি দেশবন্ধুর গৃহে পূজিত হতেন? তার সম্ভাবনা একেবারেই ছিল না বললেই চলে। কেন ছিল না সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের প্রবেশ করতে হবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনকাহিনীতে। দেশবন্ধু শরৎচন্দ্রের থেকে মাত্র ছয় বছরের বড় ছিলেন। তাঁর জন্ম, ১৮৭০ সালে। খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। পিতা ভুবনমোহন দাশ ছিলেন আইন ব্যবসায়ী, সলিসিটর। কাকা দুর্গামোহন দাশ ব্রাহ্মসমাজের বিখ্যাত নেতা ও সমাজ সংস্কারক। দেশবন্ধু ব্রাহ্ম পরিবারভুক্ত ছিলেন- কেবল একথা বললে ভুল হবে তিনি তৎকালীন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে যাঁরা হোতা ছিলেন সেইরকম একটি পরিবারভুক্ত সদস্য ছিলেন। তাঁর জ্যাঠতুতো ও খুড়তুতো ভাই-বোনদের মধ্যে আমরা অতুলপ্রসাদ সেন ও লেডি অবলা বসুর নাম উল্লেখ করতেই পারি। পিতা আইনজীবী ছিলেন বলে দেশবন্ধুকেও তিনি লন্ডনে আইন অধ্যয়নের জন্য প্রেরণ করেন। সেখানে দেশবন্ধু অরবিন্দ বসু ও সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে পরিচিত হন। সেই পরিচয় এমন গাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হয় যে আলিপুর বোমা মামলায় অরবিন্দ বসুকে তিনি প্রাণপাত পরিশ্রমের মাধ্যমে রক্ষা করেন। ১৮৯৪ সালে তিনি আইনজীবীর পেশা ছেড়ে দিয়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপে সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর অসহযোগ আন্দোলনে (১৯১৯-১৯২২) যোগদান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এছাড়া অনুশীলন সমিতি ও আলিপুর বোমা মামলার সঙ্গে যুক্ত হওয়াও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধ গঠনের জন্য তিনি ‘ফরওয়ার্ড’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে তার নাম হয় ‘লিবার্টি’। এছাড়াও তাঁর সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ নামে বাংলা পত্রিকায় শরৎচন্দ্র নিয়মিত লেখক ছিলেন। আমরা আগেই জানিয়েছি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ব্রাহ্ম ছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রকাশিত পত্রিকার নামটি দেবতার নামে কেন? আর সেই পত্রিকার লেখক কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র! যাকে তিনি নারায়ণের অবতার শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ প্রদান করছেন। সব ব্যাপারটা দেখে মনে হয় ব্রাহ্ম হলেও কৃষ্ণ চরিত্রের ওপর একটা দুর্বলতা দেশবন্ধুর ছিল। তাই তিনি মূর্তিটি শরৎচন্দ্রকে প্রদান করেছিলেন। কিন্তু কবে তা করেছিলেন? অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের জন্য তাঁকে ১৯২১ সালে ব্রিটিশ সরকার কারাগারে নিক্ষেপ করে। এই সময় তিনি মূর্তিটি শরৎচন্দ্রকে দিয়ে যান। কারণ পরিবারের সকলেই মূর্তিপুজোতে অনভ্যস্ত ও অবিশ্বাসী। এখানে মনে রাখা দরকার, ১৯২১ সালে কিন্তু শরৎচন্দ্র দেউলটির বাড়িতে আসেননি। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি দেউলটিতে বাস করেছিলেন। অর্থাৎ শিবপুরের বাড়িতে এই মূর্তি প্রথম পূজিত হন। ১৯২৪ সালে শরৎচন্দ্র যখন দেউলটিতে আসেন তখন দেশবন্ধু হয়তো এসেছিলেন কিন্তু তখন তিনি খুবই অসুস্থ থাকার কথা। ১৯২৫ সালেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই রাধাকৃষ্ণ মূর্তি  দেশবন্ধুর কাছে কেমনভাবে পূজিত হতেন সে সম্বন্ধে কিছু জানা না গেলেও শরৎচন্দ্র বিগ্রহকে ঠাকুরঘরে রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে পুরোহিত নিয়োগ করে প্রত্যহ পুজোর ব্যবস্থা করেছিলেন। যা আজও সমান নিষ্ঠায় পূজিত হচ্ছে। তবে তাঁর গৃহদেবতা রূপে ঠাকুরঘরে একটি মা লক্ষ্মীর হাঁড়িও রক্ষিত আছে। যা বারো মাসের লক্ষ্মীপুজোর ইঙ্গিত বহন করে। এই দেবীই হলেন আদি। হয়তো শরৎচন্দ্রের মা, দারিদ্র্যের সঙ্গে যিনি রীতিমতো লড়াই করেছেন তিনি এইভাবে লক্ষ্মীপুজো করতেন, সমৃদ্ধি কামনায়। কারণ স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবী মুঙ্গেরের মেয়ে। তিনি বাংলার বারো মাসের পূজনীয় মা লক্ষ্মীর হাঁড়ির সম্বন্ধে ততটা কি জানবেন? যাই হোক, গৃহে মা লক্ষ্মী আগে, পরবর্তীকালে রাধাকৃষ্ণের আগমন। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা এই রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ কি শরৎচন্দ্রের মানসিক জীবনে পরিবর্তন এনেছিল? তাঁর সাহিত্যকর্মে কি কোনও প্রভাব ফেলেছিল? সঠিক না জানা গেলেও শরৎচন্দ্রের ‘কমললতা’ উপন্যাস এই সময়েরই রচনা বলে জানা যায়।

১৯৭১-এর বিধ্বংসী বন্যায় শরৎচন্দ্রের দেউলটির বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা ভেঙে পড়েনি। ২০১৭-তে ঐতিহ্যবাহী গৃহের তকমা নিয়ে আজ সুগঠিত এবং বহু ভ্রমণপ্রেমী মানুষকে আকর্ষণ করছে। এখন প্রতিবছর ২১ জানুয়ারি থেকে ২৮ জানুয়ারি ‘শরৎমেলা’ নামে এক সাংস্কৃতিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আগে শরৎচন্দ্রের গৃহের একধারেই ছিল রূপনারায়ণ নদীর ঘাট। এখন নদী তার প্রবাহ নিয়ে বেশ কিছুটা সরে গিয়েছে। তবে বাড়ির এক অংশ থেকে তা আজও দৃশ্যমান। এই গৃহে শরৎচন্দ্র লিখেছেন পথের দাবী, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ, রামের সুমতি, বিপ্রদাস, কমললতা, পল্লীসমাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। এরমধ্যে ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের  প্রধান চরিত্র বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে করা হয়। রামের সুমতি উপন্যাসে উল্লেখিত পেয়ারা গাছটি, কার্তিক আর গণেশ নামে বিরাট মাছের পুকুরটিও দেখা যাবে। দেউলটিতে শতাব্দীপ্রাচীন বেশ কিছু মন্দিরের অবস্থান হলেও আমরা কেবল শরৎচন্দ্রের গৃহে আরাধ্য দেবতার কথা আলোচনা করলাম।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *