শরীর চিত্রকথায় শিল্পীর আত্মমুক্তি – Uttarbanga Sambad

শরীর চিত্রকথায় শিল্পীর আত্মমুক্তি – Uttarbanga Sambad

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  • সপ্তর্ষি রায়চৌধুরী

শরীরটাই যেন আস্ত একটা ক্যানভাস। আর সেই ক্যানভাসে বিচিত্র সব নকশা ফুটিয়ে তোলা মানুষের আরেক আদিম অভ্যেস, রীতি। ‘দ্য রেড হেডেড লিগ’ গল্পে জাবেস উইলসনের হাতে মাছের উলকি দেখে শার্লক হোমসের ‘এ জিনিস একমাত্র চিনদেশেই সম্ভব’ মন্তব্যের মধ্যেই প্রমাণিত— দেশাচারে উলকি বহুমাত্রিক। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও মহাজাগতিক বিশ্বাস থেকে যে প্রথা শুরু হয়েছিল আজ থেকে সাড়ে সাত হাজার বছর আগে, তা এখন একটা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট–  উন্মাদনা, ঝোঁক।

ট্যাটু করাবেন কি করাবেন না ভাবতেই দু’বছর সময় লেগেছিল প্রিয়দর্শিনীর। প্রতীক্ষা পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত উলকি আঁকাবেন বলে যখন কাচের দরজা ঠেলে স্টুডিওতে ঢুকলেন তখন কয়েকজনের শরীরে খটখট শব্দে সুচ প্রবেশ করছে দেখে তিনি তো ঘেমে নেয়ে একশা! অবশ্য শিল্পী দক্ষ হওয়ায় তাঁর সুবিধা হয়ে যায়। বিশেষ একটা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি। তবে ভয়ের রেশ ছিল হাতে লাল ফিনিক্স পাখির স্থায়ী ছাপ ধারণ করা পর্যন্ত।

আলিপুরদুয়ার বাবুপাড়ার মেয়ে প্রিয়দর্শিনী গঙ্গোপাধ্যায়। পড়াশোনার সুবাদে বেঙ্গালুরুতে বাস। যদিও ট্যাটু করিয়েছেন কোচবিহার থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, ফিনিক্সের স্বাদ পেতে প্রিয়দর্শিনীকে এত দিন অপেক্ষা করতে হল কেন? প্রথমত, বাবার আপত্তি। তীব্র নয়। তবে একটা মৃদু সংশয়। সমাজের আরশিতে তিনি দেখেছেন– ট্যাটু উন্নাসিকতা। যদিও পারিপার্শ্বিক উন্মাদনা ও মেয়ের হাসিমুখ ভেবে তিনি আর আপত্তি জারি রাখেননি। দ্বিতীয় কারণ, খরচ। আজকালকার রংবেরংয়ের কাস্টমাইজড ট্যাটু করতে বেশ ভালো টাকা ব্যয় হয়। প্রিয়দর্শিনী ট্যাটুর প্রতি আকৃষ্ট হন কুড়ি বছর বয়সে। তখন উপার্জন ছিল না। তাই মর্জি বাস্তবায়নে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।

প্রথম থেকেই উলকির নেপথ্যে কাজ করেছে একটা দর্শন। গোষ্ঠী বা সামাজিক দর্শনটা এখন পরিবর্তিত হয়ে অনেকটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রিয়দর্শিনীর কথা যদি ধরা যায়, তিনি ফিনিক্স আঁকালেন কেন? তাঁর কথায়, ‘ট্যাটুর মাধ্যমে নিজের মানসিকতাকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। আমি হারতে ভালোবাসি না। জীবনে বারবার ভেঙে পড়েছি। আবার উঠে দাঁড়াতে হয়েছে। ফিনিক্সের পুনর্জন্মের মতো।’ ব্যারাকপুরের ছেলে রোহিত দাস যেমন আবার রক মিউজিকের অন্ধভক্ত। হাতে আঁকিয়েছেন লিংকিন পার্কের লোগো। তাঁর হাত ও বুকে আরও চারটি ট্যাটু আছে। রোহিত বললেন, ‘প্রত্যেকটা আমার কাছে স্পেশাল। আমার রুচি ও ভাবনাকে বোঝায়। কোনও ট্যাটু নিয়েই আমার আক্ষেপ নেই।’

উলকির সাড়ে সাত হাজার বছরের প্রামাণ্য ইতিহাসে বহুবিধ পরিবর্তন এসেছে। প্রস্তর যুগে উলকি আঁকা হত কাঁটা ও ভেষজ রং ব্যবহার করে। মাওরিরা আবার হাড় দিয়ে সুচ তৈরি করত। সেই সময় উলকির বিষয় মূলত নানা রকম চিহ্ন, শ্লোক। এই চিহ্নের কোনওটা অশুভ শক্তি থেকে রেহাই দেবে, কোনওটা ভাগ্য ফেরাবে এই বিশ্বাসে আঁকা হত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেভাবেই চলত। প্রতিটা উলকি অর্থ বহন করে, ব্যক্তির পরিচয় তৈরি করে দেয়। সমস্ত রাশির আলাদা আলাদা উলকি আছে। আছে আস্তিক, নাস্তিক চিহ্ন। কোনও ব্যক্তির শরীরে যদি সেমিকোলন (;) থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তিনি অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন কিংবা গুরুতর কোনও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। অ্যালজাইমার্স রোগীদের গায়ে নামের ট্যাটু করা হত যাতে তাঁরা না ভুলে যান। হিটলারের চোখে যারা ‘সাবহিউম্যান’, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হিসেব রাখার খাতিরে তাঁদের গায়ে নম্বরের ছাপ দিত নাৎসি সৈন্যরা। পোল্যান্ডের আউশউইৎজে ইহুদি বন্দিদের গায়ে উলকি দাগিয়ে দেওয়া হত। বিশ শতকের শুরুতে রাশিয়া ও আমেরিকায় কুখ্যাত সব গ্যাং তৈরি হয়েছে। তাদের সদস্যদের গায়ে চিতাবাঘ, পাইথন, কাঁকড়াবিছে, মড়ার খুলি খোদাই থাকত। ক্রমে ক্রমে ট্যাটু সমাজবিরোধীদের গায়ে বেশি করে জায়গা করে নেওয়ায় সভ্যসমাজ একটা সময় ট্যাটু-বিমুখ হয়ে পড়ে।

সার্কাসের মেয়েদের শরীরে ট্যাটু দেখে বিশ শতকের গোড়ায় আমেরিকার আধুনিক মনোভাবাপন্ন নারীরা এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় দুই উলকি শিল্পী– মাউদ ওয়াগনার ও বেটটি ব্রোয়াডবেন্ডের কথা, দুই সুন্দরীই কাজ করতেন সার্কাসে– সমস্ত শরীরজুড়ে ছিল ট্যাটু— সঙ্গে তাঁরা আঁকতেনও। সত্তরের দশককে বলা হয় ট্যাটুর রেনেসাঁস। শরীরে অসামান্য সব শৈল্পিক ছবি এঁকে ফিকে হয়ে আসা ট্যাটুকে পুনরুজ্জীবিত করেন লাইল টাটেল। জ্যানিস জ্যাপলিন, চের, জো বেকার সহ আমেরিকার তৎকালীন বহু সেলেব্রিটির শরীরে তিনি ট্যাটু এঁকেছেন। ঠিক ওই সময় ফ্যাশনের মধ্যেও প্রবেশ করে ট্যাটু। জাপানের ফ্যাশন ডিজাইনার ইসে মিয়াকে জামাকাপড়ে ট্যাটু ছাপিয়ে শোরগোল ফেলে দেন। আস্তে আস্তে ট্যাটু আবার জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

বর্তমানে দেহে অন্তত একটা উলকি আছে এই নিরিখে ইতালি প্রথম, জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ। তারপর সুইডেন, আমেরিকা। অস্ট্রেলিয়ার যত মানুষের ট্যাটু আছে— তার মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ ১৮-২৫ বছরের মধ্যে করিয়েছেন। গিনেস বলছে, বিশ্বের সর্বাধিক ট্যাটুর মালিক গ্রেগরি পল ম্যাকলারেন ওরফে লাকি ডায়মন্ড রিচ। আনখশির তাঁর ট্যাটু। তবে ২০২২ সালের পর থেকে ট্যাটু মুছে ফেলার ধুম বেড়েছে। মার্কিন কমেডিয়ান, অভিনেতা পিটার ডেভিডসন দুশোটি ট্যাটু মুছে শরীর ‘পরিষ্কার’ করেছেন।

মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে বিগত কয়েক দশকে ট্যাটু নিয়ে ছুঁতমার্গই বেশি কাজ করেছে— এক অদৃশ্য চোখরাঙানি— খুঁজে পাওয়া গেছে এক নিষিদ্ধ গন্ধ। সেই ছুঁতমার্গ কি এখনও বহমান? কথা হচ্ছিল শিলিগুড়ির রাজু নাথ ও কোচবিহারের পিনাকী রায়ের সঙ্গে। দুজনেই উলকিশিল্পী। তাঁরা জানালেন, আগের চেয়ে ট্যাবু অনেকটাই কমেছে। বয়স্করাও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্যাটু করাচ্ছেন– নারী, পুরুষ নির্বিশেষে। পিনাকী যেমন বললেন, ‘৭৮ বছরেরও আমার ক্লায়েন্ট আছেন। মা, মেয়ে একসঙ্গে ট্যাটু করিয়েছেন এরকম উদাহরণ ভূরিভূরি।’

উলকিকে পেশা করার প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়ছে। তবে রাজু মনে করেন, এক্ষেত্রে সঠিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তিনি নিজেও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ছবি আঁকতে জানলে সুবিধা। তবে একেবারে গোড়া থেকেও হাতেখড়ি সম্ভব। প্রশিক্ষণের সময়সীমা ন্যূনতম ছয় মাস। খরচ ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। পুরোটাই নির্ভর করে সময়সীমার ওপর। তাছাড়া নামজাদা কোনও শিল্পীর থেকে শিখলে খরচ উনিশ-বিশ হয়ে থাকে। রাজুর কথায়, ‘শিলিগুড়ির অনেক ট্যাটু পার্লারেই ইন্টার্ন হিসাবে কাজ শুরু করে মাসে ১৫ হাজার টাকা রোজগার করছে ছেলেমেয়েরা। হাতের কাজ আর ব্যবহার ভালো হলে উপার্জন নিয়ে চিন্তা নেই। তবে নির্ভর করে শিল্পীর সুনাম ও বাজারের চাহিদার ওপর।’

পিনাকী আবার যেমন গ্রাফিক ডিজাইনারের চাকরি ছেড়ে এখন একজন প্রতিষ্ঠিত উলকিশিল্পী। কোচবিহারের ভূমিপুত্র হলেও পড়াশোনার সূত্রে কলকাতায় ছিলেন। সেখানেই নিজের শরীরে প্রথম ট্যাটু করান। এরপর ঠিক করেন, ট্যাটু আঁকবেন। কোন ধরনের ট্যাটু এখন মানুষ বেশি করাচ্ছেন? এই প্রশ্নে পিনাকীর উত্তর, ‘কাস্টমাইজড ট্যাটুই এখন বেশি হয়। ট্যাটুকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দেখেন অনেকে। একবার এক পর্বতারোহীর গায়ে তাঁর শৃঙ্গ জয়ের দৃশ্যটা এঁকে দিয়েছিলাম। চলতি ডিজাইনের বাইরে নতুনত্ব খোঁজেন সবাই।’

ট্যাবু প্রসঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার উলকিশিল্পী আয়ুষ্মান যেমন পরিষ্কার বললেন, ‘প্রাচীন সময় থেকে আমাদের দেশে উলকির প্রচলন ছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উলকি করা হত। ছত্তিশগঢ়ের রামনামী সমাজের লোকেরা সারা গায়ে উলকি করে রামনাম লেখেন। মধ্যপ্রদেশের বৈগা গোষ্ঠীর উলকির নাম গোদনা। এটিও ঐতিহ্যবাহী। জাপানের তাবোরি, ফিলিপিন্সের বাতকের মতোই এগুলো হ্যান্ড ট্যাপিং পদ্ধতি অবলম্বনে করা হয়। যন্ত্র ছাড়া সুচে লাঠি ঠুকে ঠুকে।’

বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে উলকিধারী ব্যক্তিদের রহস্যজনক চোখেই দেখা হয়েছে। কাশীর ঘাটে মছলিবাবাকে দেখে ফেলুদার সন্দেহজনক সংলাপ, বাবার হাতে বেমানান উলকি! বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখাতে পাই, ‘তখনকার দিনে নিম্নশ্রেণির স্ত্রীলোকেরা ও গ্রাম্য স্ত্রীলোকেরা উলকি পরিত।’ শরৎচন্দ্রের লেখায়, কমললতার সঙ্গে শ্রীকান্ত দেখা করেছে শুনে রাজলক্ষ্মীর ক্ষোভ– নাক খাঁদা উলকিপরা বোষ্টুমীরা মোটেই সুবিধের নয়! বর্মায় কামিনী বাড়িউলিকে ‘নষ্ট’ বোঝাতেও শরৎ শরীরে উলকি প্রয়োগ করেন। অশ্বত্থ গাছের তলায় দেবদাসের মৃত্যুতে যখন আমাদের চোখ ভেসে যায়— তখনও পারোর প্রেমিক কিন্তু শনাক্ত হন তাঁর হাতে আঁকা ‘ডি’ উলকি দিয়েই।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *