দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান। অবশেষে ভোট ছাড়াই বঙ্গ বিজেপির নতুন সভাপতি হলেন শমীক ভট্টাচার্য। লোকসভা ভোটের পর থেকেই রাজ্য সভাপতি পদে সুকান্ত মজুমদারের উত্তরসূরি খোঁজা চলছিল। একসময় দৌড়ে প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ছিলেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু দিঘায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনে সস্ত্রীক হাজিরাই দিলীপকে লড়াই থেকে ছিটকে দিয়েছে।
তারপর পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো, আসানসোল (দক্ষিণ)-এর বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পল এবং রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের নামই মূলত উঠে আসছিল। দুটো বিষয় বিবেচনা ছিল- (এক) সর্বভারতীয় নেতৃত্ব সুকান্তকে সরিয়ে নতুন কাউকে চাইছিলেন, (দুই) আরএসএস নিজের লোককেই ওই পদে বসাতে চাইছিল। এই সূত্রেই এগিয়ে যান ‘সংঘের ঘরের লোক’ শমীক ভট্টাচার্য।
১৯৭১ থেকে তিনি সংঘের স্বয়ংসেবক, ১১ বছর ছিলেন যুব মোর্চার সাধারণ সম্পাদক। তিনবারের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক শমীর বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়কও বটে। বর্তমানে একইসঙ্গে রাজ্যে দলের মুখপাত্র ও রাজ্যসভা সাংসদের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। শমীক সুবক্তা হিসেবেও পরিচিত। তাঁর মনোনয়নে প্রথম প্রস্তাবক বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মনোনয়ন পেশের সময় শমীকের সঙ্গে শুভেন্দু ও সুকান্ত দুজনেই ছিলেন।
বিধানসভা নির্বাচনের আর মাত্র নয়-দশ মাস বাকি থাকায় নতুন পদ এখন শমীকের কঠিন পরীক্ষা। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল ৭৭ আসনে। সেই সংখ্যা কমে এখন ৬৫-তে। কোনও বিজেপি বিধায়ক যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। আবার কোথাও বিজেপি বিধায়কের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। দিলীপ রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন একুশের বিধানসভা এবং উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সাফল্যের মুখ দেখেছিল।
কিন্তু সুকান্ত মজুমদার সভাপতি হওয়ার পর বাংলায় ২০২৪ লোকসভা ভোটে বিজেপির আসন কমেছে। অথচ তৃণমূলের বিরুদ্ধে ২০২১ বিধানসভা ভোটের কিছুদিন পর থেকেই একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে। দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তৃণমূলের একাধিক মন্ত্রী, বিধায়ক ও নেতা। দুর্নীতির অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাতিল হয় এসএসসি-র ২০১৬ প্যানেলে ২৫৭৫৩ জনের চাকরি।
নানা কারণে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া ছিলই রাজ্যে। তা সত্ত্বেও গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ফল ভালো হয়েছিল। তাছাড়া ১১টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে এগারোটিতেই জয়ী হয় তৃণমূল। বঙ্গ বিজেপির ছন্নছাড়া দশা চলছে বহুদিন। বিধানসভা থেকে রাজপথ, কোথাও নজরকাড়া ভূমিকায় দেখা যায় না বিজেপিকে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে গুচ্ছ গুচ্ছ কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকলেও বিজেপি বিধানসভা কিংবা বাইরে তেমন কোনও শোরগোল করতে ব্যর্থ।
বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কোনও সামান্য বিষয়েও তোলপাড় করে দিতেন রাজ্য। সম্প্রতি কালীগঞ্জে তৃণমূলের বিজয় মিছিল থেকে ছোড়া বোমায় প্রাণ হারাল দশ বছরের নাবালিকা তামান্না খাতুন। ফের ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস মনে করিয়ে দিল। বিরোধী পক্ষে তৃণমূল থাকলে হয়তো বিধানসভা অচল করে দিত। বিজেপি কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারল না।
অথচ বিজেপির বিধায়ক তালিকায় এমন একজন অর্থনীতিবিদ, সুবক্তা রয়েছেন, যাঁকে পেলে যে কোনও দলই কাঁপিয়ে দিতে পারে। তিনি বালুরঘাটের বিধায়ক অশোক লাহিড়ি। তাঁকে সেভাবে কাজে লাগাতে পারল না বিজেপি। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ মেনে নিয়েও বলতে হয়, বিধানসভায় বিতর্কের সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে ওয়াক-আউটেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিল বিজেপি।
এতদিন রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বে একতা দেখা যায়নি। যে যাঁর নিজের মতো আন্দোলন করতেন। মুখ দেখাদেখিও কম হত। শমীক ভট্টাচার্যের পক্ষে আদি-নব্য- সব গোষ্ঠীকে নিয়ে চলাটা খুব কঠিন। তার মধ্যে দিলীপকে দূরে সরিয়ে রাখলে তার প্রভাব ভালো নাও হতে পারে বিজেপিতে।