শক্তি ছাড়া শিব শব, পড়ে থাকেন শক্তির পদতলে

শক্তি ছাড়া শিব শব, পড়ে থাকেন শক্তির পদতলে

শিক্ষা
Spread the love


সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় 

বৈষ্ণব অথবা শাক্ত পণ্ডিতমণ্ডলী। তাঁরা ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী সারদা মাকে কখনও স্ত্রী বা বধূমাতা সহধর্মিণী বলতেন না, বলতেন শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তি। ধর্মের জগতে সেইটিই ছিল প্রথমা। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, শক্তি ছাড়া শিব শব। পড়ে আছেন শব হয়ে শক্তির পদতলে। এই যে পুরুষ আর প্রকৃতির মিলন, এইটিই হল সৃষ্টিতত্ত্ব। আদ্যাশক্তি মহামায়ার এই হল খেলা। তিনিই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ।

তন্ত্রসাধনার কালে পঞ্চবটীতে ঠাকুর শ্রীশ্রীজগন্মাতার মোহিনীমায়া দর্শন করেছিলেন। এক অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রীমূর্তি গঙ্গাগর্ভ থেকে উঠে ধীর পায়ে পঞ্চবটীতে একেবারে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। ক্রমে দেখলেন, ওই রমণী পূর্ণগর্ভা, পরে দেখলেন ওই রমণী তাঁর সামনেই সুন্দর কুমার প্রসব করে তাকে কত স্নেহে স্তন্যদান করছেন, পরক্ষণেই দেখলেন, রমণী কঠোর করালবদনী হয়ে ওই শিশুকে গ্রাস করে আবার ফিরে গেলেন গঙ্গাগর্ভে। জন্ম এবং মৃত্যু, সৃষ্টি ও লয় পড়ে আছে শক্তির এলাকায়।

ঠাকুর আরও একটি সুন্দর গল্প বলতেন, কিশোর বয়সে গণেশ একদিন খেলা করতে করতে একটা বেড়াল দেখতে পান। বালসুলভ চপলতায় সেটাকে নানাভাবে কষ্ট দিলেন, প্রহার করে ক্ষতবিক্ষত করলেন। বেড়ালটা কোনওরকমে প্রাণে বেঁচে পালাল। গণেশ তখন শান্ত হয়ে মায়ের কাছে এল। এসে দেখছে, জননী শ্রীশ্রীপার্বতীদেবীর শ্রীঅঙ্গের সর্বত্র প্রহার চিহ্ন। গণেশ তো কেঁদে ফেলেছেন, মা তোমার এমন অবস্থা কে করলে মা? দেবী বিমর্ষভাবে উত্তর দিলেন, তুমিই আমার এই দুরবস্থার কারণ। বিস্মিত গণেশ সজল নয়নে বললেন, সে কি কথা, মা! আমি তোমাকে কখন প্রহার করলাম? আমার কোন দুষ্কর্মের জন্যে অন্যে এসে তোমাকে এইভাবে অপমান করে গেল মা।

জগন্ময়ী শ্রীশ্রীদেবী তখন বালককে বললেন, ভেবে দেখো দেখি, কোনও জীবকে আজ তুমি প্রহার করেছ কি না? গণেশ বললেন, তা করেছি। অল্পক্ষণ হল একটা বেড়ালকে মেরেছি। মাকে এমন প্রহার করেছেন ভেবে গণেশ তখন খুব কাঁদছেন। তখন শ্রীশ্রীগণেশ-জননী অনুতপ্ত বালককে আদর করতে করতে বলছেন, বোঝাচ্ছেন, তা নয় বাবা, তোমার সামনে এই যে আমার শরীর, এই শরীরকে কেউ প্রহার করেনি, কিন্তু আমিই যে মার্জারাদি যাবতীয় প্রাণীরূপে সংসারে বিচরণ করছি, সেই কারণেই তোমার প্রহারের চিহ্ন আমার শরীরে ফুটে উঠেছে। তুমি না জেনে এমন কাজ করেছ। দুঃখ কোরো না, তবে আজ থেকে মনে রেখো, স্ত্রীমূর্তি-বিশিষ্ট সমস্ত জীব আমার অংশে উদ্ভূত আর পুংমূর্তিধারী জীবসমূহ তোমার পিতার অংশে জন্মেছে। শিব ও শক্তি ভিন্ন জগতে কেউ নেই, কিছুই নেই।

মায়ের ওই কথাটি গণেশের হৃদয়ে গেঁথে গেল। ফল হল এই, বিবাহযোগ্য বয়স যখন হল, তখন মাকে বিবাহ করতে হবে ভেবে উদ্বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হতে অসম্মত হলেন। শ্রীশ্রীগণেশ চিরকাল ব্রহ্মচারী হয়ে রইলেন, আর শিবশক্ত্যাত্মক জগৎ এই কথা হৃদয়ে সর্বদা ধারণ করে থাকায় জ্ঞানীগণের অগ্রগণ্য হলেন।

এবার একটি বিশ্লেষণে আসা যাক। আমাদের হিন্দু ধর্মে সন্ন্যাসের উদ্ভব কবে থেকে হল। বেদের ঋষিরা সন্ন্যাসী ছিলেন না। ব্রহ্মচিন্তা ও ব্রহ্মজ্ঞান ধারণের জন্য ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজন। অবশ্যই প্রয়োজন। স্বামীজির কথা উদ্ধৃত করছি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে। ব্রহ্মচর্যবান ব্যক্তির মস্তিষ্কে প্রবল শক্তিমহতী ইচ্ছাশক্তি সঞ্চিত থাকে। যত মহা মহা মস্তিষ্কশালী পুরুষ দেখা যায়, তাঁরা সকলেই ব্রহ্মচর্যবান ছিলেন।

যোগীরা বলেন, মনুষ্যদেহে যত শক্তি অবস্থিত, তাদের মধ্যে মহত্তম শক্তি ওজঃ। এই ওজঃ মস্তিষ্কে সঞ্চিত থাকে। যার মস্তকে যে পরিমাণে ওজোধাতু সঞ্চিত থাকে, সে সেই পরিমাণে বুদ্ধিমান ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান হয়। মানুষের মধ্যে যে শক্তি কামক্রিয়া, কামচিন্তা ইত্যাদি রূপে প্রকাশ পাচ্ছে, তা সংযত হলে সহজেই ওজোরূপে পরিণত হয়ে যায়। পবিত্র কামজয়ী নরনারীই কেবল এই ওজোধাতুকে মস্তিষ্কে সঞ্চিত করতে সমর্থ হন। এই জন্যই সর্বদেশে ব্রহ্মচর্য শ্রেষ্ঠ ধর্মরূপে পরিগণিত হয়েছে। মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে, অপবিত্র হলে এবং ব্রহ্মচর্যের অভাবে আধ্যাত্মিক ভাব, চরিত্রবল ও মানসিক তেজ–সবই চলে যায়। এই কারণেই দেখতে পাবে, জগতে যেসব ধর্ম-সম্প্রদায় থেকে বড় বড় ধর্মবীর জন্মেছেন সেই সকল সম্প্রদায়ই ব্রহ্মচর্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে।

আমার মনে হয়, কোনও জাতিকে পূর্ণ ব্রহ্মচর্য আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে তাকে সর্বপ্রথমে বিবাহের পবিত্রতা ও অবিচ্ছেদ্যতার মধ্যে দিয়ে মাতৃত্বের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার ভাব অর্জন করতে হবে।

অর্থাৎ সন্ন্যাস ও ব্রহ্মচর্য অভিন্ন। গার্হস্থ্য ধর্ম ও সন্ন্যাস ধর্মের মধ্যে তৈরি হল বিরাট এক বিভাজন। ভোগ আর যোগ আলাদা হল। গৃহী সংসারী ভোগমার্গী। সন্ন্যাসী যোগমার্গী। শ্রীভগবান এইবার যোগের বিভিন্নতা ব্যাখ্যা করলেন। সাংখ্যযোগের দর্শন নিয়ে কর্মযোগে এস।

হে অর্জুন, বেদের কর্মকাণ্ড কামনামূলক ও সংসৃতিদায়ক। অতএব, প্রথমে তুমি নিষ্কাম হও এবং ঈশ্বরার্থে কর্ম কর। সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্বরহিত ও সদা সত্ত্বগুণাশ্রিত হও এবং যোগ (এখানে যোগের অর্থ হল অপ্রাপ্তের প্রাপ্তি) এবং ক্ষেমের (প্রাপ্তের রক্ষণের) আকাঙ্ক্ষারহিত ও অপ্রমত্ত হও।

অর্জুন তো সন্ন্যাসী নন। রাজপুত্র, যোদ্ধা। রক্ষা ও প্রজাপালনই তাঁর রাজধর্ম। একবারও কট্টর সন্ন্যাসী শঙ্করাচার্যের মতো বললেন না, অর্জুন সব ছেড়ে পালাও।

স্বযং গোবিন্দ যাঁর রথে, তিনি বারেক বললেন না, ভজ গোবিন্দঃ, ভজ গোবিন্দঃ মূঢ়মতে! বরং, মায়ার মধ্যে বসে মায়াকে চেনবার জন্যে সরাসরি ব্রহ্মজ্ঞান দিলেন। সমস্ত অঞ্চলটাই যদি প্লাবনে জলমগ্ন হয়, তাহলে জলের জন্যে কূপ প্রভতি ক্ষুদ্র জলাশয়ের সন্ধানের প্রয়োজন হয় না। যেখানে যাবে সেইখানেই জল, সেইরকম ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষও পূর্ণোদকস্থানীয়। তার ব্রহ্মচেতনায় বেদোক্ত সকল কাম্য কর্মের ফল অন্তর্ভুক্ত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ এই বিষয়টিকে একটু অন্য গঠনে বলেছেন, বনে এলে আর বাঁকা নদী দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হয় না। তখন মাঠের ওপর একবাঁশ জল।

শ্রীরামকৃষ্ণ আরও বললেন, ব্রহ্মের মায়ার কথা। বিভু আর শক্তি জড়িত, যেমন জল আর জলের হিমশক্তি, অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তি। মায়ার শ্রেণিবিভাগ করলেন, বিদ্যা মায়া আর অবিদ্যা মায়া। বিদ্যারূপিণী স্ত্রী আর অবিদ্যারূপিণী স্ত্রী।

সন্ন্যাসী নারীর পট পর্যন্ত দর্শন করবে না। পরামর্শটা হল, পালাও পালাও। শঙ্করের সন্ন্যাস ধর্ম কাম জয়ে যে পথ দেখিয়েছে, তা হল ঘৃণা। নারীকে ঘৃণা করো। কামিনী আর কাঞ্চন, এই দুই মায়া থেকে দূরে থাকলেই ব্রহ্মজ্ঞান। অতই সহজ! মনের নাশ না হলে ব্রহ্মজ্ঞান আসবে না।

এই সমস্যার সমাধানে এলেন অবতার শ্রীরামকৃষ্ণ। স্ত্রী গ্রহণে তাঁরও যথেষ্ট সংকোচ ছিল। তোতাপুরী যখন সন্ন্যাস দিতে চাইলেন, তখন ঠাকুর নিঃসংকোচে বলেছিলেন, আমি যে বিবাহিত। তোতাপুরী বলেছিলেন, তাতে কী হয়েছে, সেইটাই তো আমার পরীক্ষা। নিজেকে যাচাই করে নিতে পারবে আরও ভালোভাবে। এ যেন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা। নারীকে ত্যাগ নয়, লক্ষ্য কামজয়ী হওয়া। গণেশ আর গণেশজননীর উপাখ্যান বর্ণনা করে ঠাকুর বলেছিলেন, রমণীমাত্রে গণপতির মাতৃভাব বদ্ধমূল হওয়ায় তিনি আজীবন ব্রহ্মচারীই থেকে গেলেন। আমারও রমণীমাত্রে ওইরূপ ভাব, সেইজন্য বিবাহিত স্ত্রীর ভেতরে শ্রীশ্রীজগদম্বার মাতৃমূর্তির সাক্ষাৎ দর্শন পেয়ে পূজা ও পাদবন্দনা করেছিলুম।

শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রসাধক ছিলেন। সাক্ষাৎ শিব। বীর, তাই বুকঠুকে বলতে পেরেছিলেন, রমণীর সঙ্গে থাকি না করি রমণ। কারণ, আমার সন্তান ভাব। সমস্ত রমণীই আমার মা।

তাহলে বিবাহ কেন? কারণ, দুটো। এক দশবিধ সংস্কারের এটি সংস্কার বিবাহ। দুই, উদাহরণ। সন্ন্যাস! সে তো সন্ন্যাসীর জন্যে আছেই, গৃহীরাও ঈশ্বর লাভ করতে পারবে, যদি ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকে। তার জন্যে সব ছেড়ে বনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন, অন্তর্বৈরাগ্য, বিশ্বাস এবং ভক্তি। শ্রীভগবান অর্জুনকে বলেছেন, হে অর্জুন, কেবলমাত্র অনন্য ভক্তিদ্বারাই ঈদৃশ আমাকে জানতে ও স্বরূপত প্রত্যক্ষ করতে এবং আমাতে প্রবেশরূপ মোক্ষলাভ করতে ভক্তগণ সমর্থ হয়, অন্য উপায়ে নয়। ঠাকুর একটি অবাক স্বীকারোক্তি করেছেন, যার অর্থ হল, সারদা মা যদি অন্যরকম হতেন তাহলে শ্রীশ্রীঠাকুরের কী হত, তিনি নিজেই জানেন না। মা সারদার শক্তিই ঠাকুরের সাধকজীবনের আচ্ছাদনী ধর্ম। যার জোরে ঠাকুর গৃহদুর্গে বসে সাধনভজনের পরামর্শ দিতে পেরেছিলেন।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *