- সৌরভ মজুমদার
‘তেরে দর পর সনম চলে আয়ে,
তু না আয়া তো হম চলে আয়ে।’
আমাকে আজকে যদিও আসতেই হত এখানে। রবিবার গড়পড়তা মধ্যবিত্তর ওই একটাই ঠিকানা- পাড়ার সেলুন। আর হ্যাঁ, ঠিক এখানেই কুমার শানু বেজে চলেছে। এসিও চলছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গরমাগরম জোর আলোচনা- ভারতীয় নৌসেনার করাচি কাণ্ড। বিক্রান্তের গতি নিয়ে সেখানে তুমুল বিতর্ক। আরাম করে আমি চোখ বন্ধ করে এসব শুনছি। মজা নিচ্ছি ফেক নিউজের নিজস্ব কমেডি সার্কাসের। আর বিজয় দুই হাত দিয়ে ম্যাজিকের মতো আমার কাঁধে আঙুলের চাপ বসাচ্ছে। বিজয়ের বাবা মানে ঈশ্বরদা এখন আর তেমন কাজ করেন না। আমি আয়না দিয়ে দেখলাম- ঈশ্বরদা, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আর চেয়ারে এসে বসলেন একজন অসম্ভব হ্যান্ডসাম মানুষ। তবে এখন চেহারার জেল্লা অনেকটাই কমে এসেছে। সেই ঘন চুল পাতলা হতে হতে অনেকটাই গায়েব। কিন্তু হাসিটা এক রকম আছে। আরে এই তো আমাদের পাড়ার ‘রাঙাদা’। ভালো নাম রঙ্গন রায়চৌধুরী। কর্পোরেটে নাম করেছে দারুণ। আজ প্রায় এক দশক পর দেখা। রাঙাদা সংসারী হয়েছে দীর্ঘদিন। অথচ রাঙাদাকে দেখেই আমার প্রথমেই যে কথাটা মনে পড়ে সেটা হল মিষ্টিদি। নাইন্টিজের শেষ ভাগ। সদ্য বয়ঃসন্ধিকাল আমার, আর সমবয়সি পাড়ার সকলেই রাঙাদা হতে চায় তখন। কারণ, রাঙাদার জয়েন্টে মেধাতালিকায় নাম। তবে রাঙাদার নেক নজর আমার দিকে। সেই প্রথম আমার টেস্ট পেপার সরিয়ে রেখে গুপ্তচরবৃত্তির শুরু। প্রত্যেক শুক্রবার ঈশ্বরদার সেলুনে মিষ্টিদিকে দেওয়ার জন্য রাঙাদার চিঠি নিতে আমার যাতায়াত। এছাড়াও রাঙাদাকে মিষ্টিদির টিউশনির টাইম, স্কুলে ফেরার রাস্তা, বন্ধু-বান্ধবীদের তালিকা ইত্যাদি জোগাড় করে দেওয়ার ঝক্কি তো ছিলই। মিষ্টিদি রাঙাদার কোনও বেনামী চিঠিরই কোনওদিন উত্তর দেয়নি। শেষ দুটো চিঠি মিষ্টিদি নিতে রাজি না হওয়ায় ঠিক হয় যে, শারজায় ইন্ডিয়া পাকিস্তান ফাইনাল ম্যাচের দিন রাঙাদা আমাকে নিয়ে ওর টিউশনির গলির পেছন দিকটায় যাবে। মফসসলের দুপুরবেলা। সমস্ত দোকানদার শাটার ফেলে ঘুমোচ্ছে। পাড়াতে খুব বেশি টিভি নেই, থাকলেও কেবল নেই। অতএব, ঈশ্বরদার সেলুনে ছেলেছোকরাদের হেব্বি ভিড়। ওখানেই খেলা দেখা চলছে। আর এদিকে রাঙাদার চোখমুখ বসে একাকার। টস শেষ হতেই আমি দোকানে এসে হাজির হলাম। ইন্ডিয়া ব্যাট পেয়েছে। ব্যাস, সাইকেলে আমাকে নিয়ে রওনা দিল রাঙাদা। প্যারালালি ওয়াসিম আক্রাম সাদা বল হাতে নিয়ে রান আপের দিকে দৌড়াচ্ছে। গলির মোড়ে পৌঁছাতেই দেখলাম মিষ্টিদি একটি ছেলের হাত ধরে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। রাঙাদা সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল। শচীন তেন্ডুলকার ব্যাটিং স্টান্স ঠিক করে ব্যাট চালাতেই আমি দেখলাম রাঙাদার উইকেটটা পড়ে গেল। সেই প্রথম আমার স্পাইগিরি করতে গিয়ে আউট হয়ে যাওয়া। ব্যস্ততা ছিল বলে কুশল বিনিময়েই সমস্তটা সীমাবদ্ধ রেখে, মাথায় ফ্ল্যাশব্যাক চালিয়ে বাড়ি ফিরে দৌড় লাগালাম স্নানঘরে।
রোববারের মাটনের সঙ্গে যাপনের হেব্বি ইয়ারি। শ্যাম্পুর কৌটো হাতে আলসেমির এসরাজ। স্নান সেরে এবার বিছানায়। হাতে নতুন কেনা বইটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছি। ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড বার্লিন।’ এ যেন গুপ্তচরবৃত্তি ও ইতিহাসের কাটাকুটি। এর মধ্যেই বন্ধুর ফোন। বিকেলের প্ল্যানটা ফিক্সড হতেই পুরোনো দিন যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই কলেজের ১২ নম্বর রুম। পাশ কোর্সের কেমিস্ট্রি ক্লাস। সাদা সালোয়ার পরা একটা মাঝারি উচ্চতার মিষ্টি মেয়ে। দুই মাসের দৌড়াদৌড়ির পর আমার এই একটু আগের কলের গুপ্তচর বন্ধু নামটা জানিয়েছিল মেয়েটির। তার এক মাস পরে ঠিকানা। আরও তিন মাস পর ১০ ডিজিটের একটা নম্বর। তারপর সরাসরি পরবর্তী ইনিংস। জয় গোস্বামী ধার করলে, “যাও আজীবন অশান্তি ভোগ করো।” আর ঠিক এই কারণেই, আমার সেই স্পাই বন্ধুকে কুর্নিশ জানাতে এখন আমার কুণ্ঠাবোধ হয়।
যাই হোক, যার কথা বলছিলাম আর কী, তিনি এসে হাজির। অতএব বই বন্ধ। উনি এখনও জানেন না আজ বয়েজ নাইট আউট আছে। জানলে হয়তো আমি নট আউট থাকব না। বাইরে আকাশের মতন এদিকে ওঁরও থমথমে মুখ। বুঝতে পারছি কেজিবি আর সিআইএ’র মধ্যে আবার কিছু ঘটেছে। ধরতে পারলেন না তো! সহজ করে বলি, শাশুড়ি বনাম বৌমা। ঘর ঘর কী কাহানি। এদের আবার পরিবারের মধ্যেই অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তি আছে। দুজনেরই অকাট্য যুক্তি, নিখুঁত তর্ক। হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র। একজনের কল রেকর্ড, অপরজনের স্ক্রিনশট। বিষয় হয়তো সামান্য তবে আয়োজন প্রশ্নাতীত। ইগনোরের নামতা এখানে কাজ করবে না কখনোই। বাড়ির সত্যনারায়ণপুজোর দিন দোকানে আমিষ খেয়ে মিথ্যে বলতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়েছেন উনি। সৌজন্যে ইনস্টাগ্রাম পোস্ট ও সিস্টারের স্টকিং স্কিল। আর এদিকে সেই নিয়ে আত্মীয়দের কাছে মায়ের পরোক্ষ ভর্ৎসনা ওর কানে তুলে দিয়েছে স্বয়ং ওর ব্রাদার-ইন-ল। পরিবারের নিজস্ব স্পাই ইউনিভার্স। খাবার টেবিলে শান্তি চুক্তির বার্তা নিয়ে কষা মাংসে কামড়। তারপর চিরাচরিত ভাতঘুম।
বিকেলে উঠেই তুমুল বৃষ্টি। চায়ের সঙ্গে পকোড়ার মোক্ষম কম্বিনেশনে হালকা করে অরিজিৎ সিং। এর মধ্যেই মোবাইলের রিংটা বেজে উঠল। আবার কৌশিকের ফোন। সেই কলেজের গুপ্তচর বন্ধু। ওর নাম কৌশিক রায় হলেও, আমার কাছে ও রবীন্দ্র কৌশিকের চেয়ে কম কিছু নয়। বিকেলের প্ল্যানটা আজকের মতো ক্যানসেল হয়ে গেছে। বৃষ্টির জন্য মুলতুবি থাকছে নাইট আউট। এ যাত্রায় ভালোই হল। কাদামাখা রাস্তায় বেরোতে কেমন লাগে। বয়সের সঙ্গে বৃষ্টি নিয়ে রোমান্টিসিজমের একটা ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক আছে।
তাই মোবাইল নিয়ে টুকটাক রিল দেখছি, দেখি অফিসের গ্রুপে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে গেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ওপর সাম্প্রদায়িক স্টেটমেন্ট। তা থেকে বলতে গেলে ভার্চুয়াল রায়ট। এর মধ্যে আবার কয়েকজন সিনিয়ারদের পোষা স্পাইয়ের স্ক্রিনশটফিলিয়া। ব্যাপারটা যখন খারাপের দিকে এগোচ্ছে তখন কয়েকজনের পাল্লা দিয়ে মেসেজ ডিলিট ফর অল করার ধুম। এসব তামাশার মজা নিতে নিতেই ডিনার টেবিলে বসে অবধারিত স্মানডেয়িং। খেয়ে উঠেই সঙ্গে সঙ্গে তো আর ঘুম পায় না। সমাজমাধ্যমে খবর স্ক্রল করছি। দেখছি প্রত্যেক ফিডে একজনেরই মুখ। জ্যোতি মালহোত্রা। হরিয়ানার এই মেয়েটি নাকি নিউ এজ স্পাই। হিসার থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে। সারাদিন যত বাজে খবর। বিরক্তির সঙ্গে মোবাইলটা রেখে শুতে গিয়ে মনে পড়ল দাদামণি ওর ছেলেটার ওপর নজর রাখতে বলেছিল। ওর বন্ধুসঙ্গ, পড়াশোনা, অ্যাম্বিশন ইত্যাদি। ওদের বাড়িতেও যাওয়া হল না। কোনও খোঁজও নেওয়া হল না। শুধু শুধু আরেকটা রবিবার জীবন থেকে বেরিয়ে গেল।