লাগামহীন বিশৃঙ্খলার সার্কাস চারদিকে

লাগামহীন বিশৃঙ্খলার সার্কাস চারদিকে

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


 

  • গৌতম সরকার

এটা দল? না ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ খেলার মাঠ! শৃঙ্খলা না থাকলে কীসের দল! যিনি যেমন খুশি চলছেন। তৃণমূলের কথা ভাবুন শুধু কোচবিহারেই দলীয় বিশৃঙ্খলার নানা মডেল! সদ্য কোচবিহার পুরসভার বাজেট বৈঠকে যোগ দিলেন না তৃণমূলের সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলার। মুখে নানা অজুহাত। ব্যাপারটা কী? পুরসভার চেয়ারম্যান পদে রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে তাঁদের না-পসন্দ। রবি হটাওয়ের এই চেষ্টার টিমে দলের কোচবিহার জেলা সভাপতি অভিজিৎ দে ভৌমিকও আছেন।

এসব বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কী! তাতে দলের কী হবে, তা নিয়ে নাহয় আমাদের আমপাবলিকের মাথাব্যথার কারণ নেই। কিন্তু পুর বোর্ড সক্রিয় না থাকলে, মিটিং না হলে যে উন্নয়ন, পরিষেবা সব শিকেয় ওঠে। সেই বিশৃঙ্খলায় খেসারত দিতে হয় তো শহরের বাসিন্দাদের। তাতে তৃণমূলের হেলদোল নেই। না দলের কাউন্সিলারদের, না জেলা কমিটির, না রাজ্য নেতৃত্বের। বলতে পারেন, তৃণমূলের দোষ ধরছেন, অন্য দলগুলি কি ধোয়া তুলসীপাতা! এক্কেবারে না!

বিজেপির জেলা সভাপতি বাছাই নিয়ে না কত নাটক হল! জলপাইগুড়িতে এমন বিদ্রোহ হল যে, নবনির্বাচিত সভাপতিকে প্রথম বৈঠক করতে হল জেলা সদরের বাইরে ময়নাগুড়িতে। মোবাইল, গাড়ি ইত্যাদি জেলা সভাপতিকে ভেট না দিলে পদ জোটে না বলে বিজেপির নামে পোস্টারে ছেয়ে গেল দক্ষিণ কলকাতা। সেখানকার অপছন্দের নেতার মুখে কালি ছিটিয়ে দেওয়ার ছবি ভাইরাল হল। বিজেপি নেতৃত্ব কিন্তু কোনও পদক্ষেপ করল না।

শৃঙ্খলা, দলীয় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছাচারের টাটকা উদাহরণ জন বারলা। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। ডুয়ার্সে প্রভাবশালী চা শ্রমিক নেতা। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপি ছাড়েননি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভামঞ্চে গিয়ে তৃণমূলে যোগ দেবেন জানিয়ে এসেছেন। গত লোকসভা ও মাদারিহাট বিধানসভার উপনির্বাচনে দলের হয়ে প্রচার করেননি।

বিজেপি কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করেনি। ‘গো অ্যাজ ইউ লাইকে’র এই সংক্রমণ সর্বব্যাপী। কংগ্রেসে বরাবর ছিল। লৌহকঠিন শৃঙ্খলায় মোড়া বলে দাবি করে যে সিপিএম, সেই দলে জেলা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কী হল দেখলেন তো! দক্ষিণ ২৪ পরগনায় নির্বাচিত প্যানেল থেকে সরে দাঁড়ালেন তাবড় নেতারা। পরিস্থিতির চাপে সম্মেলন হলেও জেলা সম্পাদক নির্বাচন ঝুলে আছে।

উত্তর ২৪ পরগনায় আবার সম্মেলনে জেলা কমিটি করাই গেল না বিশৃঙ্খলায়। পরে আলাদা বৈঠক ডেকে কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে কমিটি তৈরি হলেও সমস্যার গোড়া থেকে গিয়েছে। যা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রতিফলন। বাম দলগুলি যাকে এতদিন দুই লাইনের লড়াই বলে বিশৃঙ্খলাকে অন্য মোড়ক দিত। দুই ২৪ পরগনায় নিয়ম ভেঙে এই ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’-এর জন্য সিপিএম নেতৃত্বও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি।

ব্যবস্থা নেওয়া হয় না ভয়ে। পাছে বিদ্রোহীরা ‘রইল ঝোলা, চলল ভোলা’ বলে ঝাঁকে ঝাঁকে অন্য দলের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে যান। কোচবিহারে রবীন্দ্রনাথ প্রবীণ নেতা। প্রতিষ্ঠার দিন থেকে তৃণমূলের সৈনিক। পুরসভা পরিচালনায় তিনি ব্যর্থ হতেই পারেন। তা নিয়ে দলে আলোচনা হতে পারে। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বকে নালিশ জানানো যেতে পারে। তা না করে পুর বোর্ডের সভা বয়কট! যেটা বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কী!

এ রকম উদাহরণ অজস্র। মেখলিগঞ্জে নেতৃত্বের নির্দেশ উপেক্ষা করে পুরসভার চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দিলেন তৃণমূল কাউন্সিলাররা। তুফানগঞ্জেও তাই। দলের বৈঠকে নেতারা একে অপরের মুখ দেখেন না। জেলা নেতৃত্ব বৈঠক ডাকলে যান না রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, পার্থপ্রতিম রায়রা। আবার দ্বিতীয় পক্ষের ডাকা সভা এড়িয়ে চলেন অভিজিৎ দে ভৌমিক, উদয়ন গুহরা। এই বিদ্রোহ কেন? দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার এই প্রতিযোগিতার নেপথ্যে আছে গোষ্ঠীবাজি কিংবা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভাগীদার হতে না পারার অসন্তোষ।

অথচ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেই। তৃণমূল নেতৃত্বের নীরবতায় উলটে বিদ্রোহে সিলমোহর পড়ছে। রাজ্য নেতৃত্ব মাঝে মাঝে হুংকার দেয়। বলা হয়, এসব বরদাস্ত করা হবে না। কিন্তু কিছুই হয় না। জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজারে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ নিয়ে কত নাটকই না হল। এখন আটকে আছে ভাইস চেয়ারম্যান বাছাই। গোষ্ঠীস্বার্থ ছাড়া আটকে থাকার অন্য কোনও কারণ নেই। তাতে পুরসভার কাজকর্ম লাটে উঠলে উঠবে। মানুষের পরিষেবা আটকে গেলে যাবে!

শিলিগুড়ি পুরনিগমে তৃণমূল কাউন্সিলার দিলীপ বর্মনের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণই নেই। তিনি নিজের মতো চলেন। তাতে দল, পুরনিগম, প্রশাসন অস্বস্তিতে পড়লেও নেতারা কোনও পদক্ষেপ করেন না। বরং হিসেব চলে, বিদ্রোহী কাউন্সিলার কার কাছের লোক। ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলুন আর মানিকচকের বিধায়ক সাবিত্রী মিত্র, নিজের এলাকায় অন্য কোনও নেতাকে তাঁরা সহ্য করেন না। যেন আলাদা রাজত্ব, আলাদা রাজা সবাই।

মুর্শিদাবাদ জেলার বিধায়ক হুমায়ুন কবীর প্রায়ই দলের ‘অনুশাসন’ ভাঙেন। যদিও অনুশাসন বলে তৃণমূলে কিছু আছে কি না সন্দেহ। তাঁকে রাজ্য নেতৃত্ব কখনও সতর্ক করেন, কখনও শোকজ করেন। সর্বশেষ বিধানসভায় দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে তিনি প্রায় মুচলেকা দিয়েছেন এমন কাণ্ড আর করবেন না বলে। তারপরেও শুধু তাঁর বেলা ‘আঁটিসুঁটি, পরের বেলায় দাঁতকপাটি’ গোছের মন্তব্য করে নিশানা করেছেন দলের নেতৃত্বকে।

এরপরেও তাঁর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ হওয়ার সম্ভাবনা যে প্রায় নেই, তা হলফ করে বলে দেওয়া যায়। বিশৃঙ্খলার স্বর্গ এখন সব দলে। নেতাদের এই বেপরোয়া আচরণের প্রভাব পড়ে সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের ওপর। তাঁরাও আক্রান্ত যথেচ্ছাচারের রোগে। বিশৃঙ্খলার সার্কাস চলছে নিরন্তর।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *