রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: রাহুল দ্রাবিড়-উত্তর সময়ে তিনি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের শ্রীযুক্ত নির্ভরযোগ্য। বর্তমানে জাতীয় দলের বাইরে। কিন্তু দেশজ ক্রিকেটের অধুনা ট্রানজিশন পর্ব নিয়ে বলার মতো যোগ্য চরিত্র তাঁর চেয়ে ভালো আর কে আছে? চেতেশ্বর পূজারাকে যে রাহুল দ্রাবিড়ের জুতোয় পা গলাতে হয়েছিল। শহরে এসে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পূজারা যা বললেন, তাঁর বয়ানে তুলে দেওয়া হল।
‘…কিসমত কানেকশন কি না জানি না, তবে কলকাতার সঙ্গে আমার ক্রিকেট যোগাযোগ আজকের নয়। কেকেআরের হয়ে খেলার সময়ে এই শহরের ক্রিকেট-উন্মাদনা টের পেয়েছি। সেই আবেগকে সুনামি হতে দেখেছি ইডেন গার্ডেন্সে ভারতীয় দলের জার্সিতে। সেই স্মৃতি আজও অমলিন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ধারাভাষ্যের ফাঁকে ওয়াসিম (আক্রম) ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডাতেও বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে কেকেআর আর কলকাতা। যাই হোক, অতীত ছেড়ে বর্তমানে ফিরি। ইতিহাস রচনার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় দল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে পারলেই ইতিহাস গড়বে রোহিত শর্মারা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার সুযোগ। এই সাফল্য কাকতালীয় নয়, এটা একটা ‘প্রসেস’, যার সুফল পাচ্ছে টিম ইন্ডিয়া। এখন ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে গোটা দল। শুভমান গিল, যশস্বী জয়সওয়ালরা উঠে আসছে। আসলে ভারতীয় ক্রিকেটে প্রতিভার অভাব নেই। নতুনরা প্রত্যেকেই সম্ভাবনাময়। তবে প্রত্যেকের স্টাইল অফ প্লে আলাদা, সেই দক্ষতাকে ঠিকভাবে ব্যবহার করা উচিত টিম ম্যানেজমেন্টের। পাশাপাশি দল কী চাইছে, তা উপলব্ধি করাটাও প্লেয়ারদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনেক সময় পরিস্থিতি ব্যাটারদের অনুকূলে থাকে না। তখন বিপক্ষ বোলিং পরিস্থিতি, উইকেটের কন্ডিশন অনুযায়ী ব্যাট করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। টেস্ট ক্রিকেটে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটি করা বিচক্ষণতার পরিচয়। তার জন্য কঠোর পরিশ্রম দরকার। এক্ষেত্রে নিজেকে ভাগ্যবান বলব।
কারণ, আমি যে সময়ে ভারতীয় দলে সুযোগ পাই, সে সময়ে ড্রেসিংরুমে শচীন, রাহুল, লক্ষ্মণ ভাইয়ের মতো প্লেয়ারকে পেয়েছি। নেটে তাঁদের দেখেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করে যেতে, যাতে ম্যাচে ভুল না হয়। সিনিয়রদের সেই অধ্যাবসায় থেকে শেখার চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করেছি রাহুল ভাইয়ের পরামর্শ কাজে লাগাতে। বর্তমান ভারতীয় দলে শুভমান, যশস্বীর মতো তরুণরা দারুণ খেলছে। যত অভিজ্ঞতা ওরা সঞ্চয় করতে পারবে, তত ওদের খেলায় বৈচিত্র্য আসবে। বিদেশ সফর এই কারণেই একজন প্লেয়ারের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ। সাফল্য-ব্যর্থতা যা-ই আসুক, বিদেশের মাটিতে খেলার মধ্যে দিয়ে যে অভিজ্ঞতা ক্রিকেটাররা অর্জন করে, তার গুরুত্ব অপরিসীম। সেটা টেস্ট ফরম্যাটে আরও বেশি করে বোঝা যায়। ক্রিকেটে টেস্ট ফরম্যাট হল অল্টিমেট স্টেজ। সেখানে সাফল্য পেতে গেলে শৃঙ্খলাপরায়ণ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর সাফল্য পেতে গেলে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। টেস্টে আরও বেশি করে।
টেস্টের কথাই যখন উঠল, বস্তুর গাভাসকর ট্রফির প্রসঙ্গ না বললেই নয়। ভুলে গেলে চলবে না সাফল্য-ব্যর্থতা খেলার অঙ্গ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ হার আমাকেও প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে। শুরুটা ভালো হলেও পরে সেই ছন্দ আমরা ধরে রাখতে পারিনি। বোলিং দারুণ হলেও ব্যাটিংয়ে খামতি ছিল, যা তফাত গড়ে দিয়েছে। স্কোরবোর্ডে যতটা রান তোলা দরকার ছিল, আমরা তা তুলতে পারিনি। সবমিলিয়ে দলগত পারফরম্যান্স আর একটু ভালো হলে বেটার রেজাল্ট হত। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দলে থাকলে জেতার বাড়তি তাগিদ নিয়ে মাঠে নামতাম। বিদেশ সফরের জন্য সবসময় আলাদা প্রস্তুতি দরকার। ২০১৫-তে যখন প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া যাই, তেমন সাফল্য পাইনি। ২০১৮-তে তাই মাসদেড়েক আগে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম। সিমেন্টের ভেজা উইকেটে ১৬-১৮ গজের পিচে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করি। সেই পরিশ্রমের ফল মিলেছিল অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি পিচে। ২০২১-এ লড়াই আরও কঠিন ছিল। আমরা সেই পরিস্থিতিতে দারুণ কামব্যাক করেছিলাম। বলের আঘাত সহ্য করেছিলাম মুখ বুজে। আসলে দেশের হয়ে খেলার সময় তখন আর যন্ত্রণার কথা মনে থাকে না। শুধু একটা কথাই ভাবছিলাম, ২০১৮-তে আমরা অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জিতেছি, এবারও পারতে হবে। দুর্ভাগ্য, শেষ সফরে তা হল না। স্বীকার করতে দোষ নেই, অস্ট্রেলিয়া বেটার ক্রিকেট খেলেছে। তবে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
অতীত ভুলে এবার সামনে তাকানোর পালা। সামনে ইংল্যান্ড সফর রয়েছে। পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। নিজের প্রসঙ্গে বলতে পারি, সুযোগ পেলে সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব। দলের প্রয়োজনে সবসময় আমি তৈরি। তা মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করছি, কাউন্টিতে খেলছি, ফিটনেসেও বাড়তি নজর দিচ্ছি। অস্ট্রেলিয়ায় সুযোগ না পাওয়ার হতাশা আছে। তবে পরিশ্রম করলে নিজেকে প্রমাণের খিদে বাড়ে, তা অনুভব করতে পারছি। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ সাইকেলে এই টেস্ট সিরিজ ভারতীয় দলের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। শুরুটা ভালো হওয়া দরকার। অভিজ্ঞতা একটা বড় ফ্যাক্টর। তা কাজে লাগাতে হবে। বিদেশের পরিস্থিতিতে নিজেকে মেলে ধরা সহজ নয়। আশা করব, ইংল্যান্ডে ভালো ফল করবে দল। দলের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করবে বিরাট, রোহিতের মতো সিনিয়রের ওপর। বিরাট-রোহিত, দু’জনের এখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে ভারতীয় ক্রিকেটকে। সিনিয়র ক্রিকেটারদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে ইংল্যান্ডে। তরুণদের ব্যাকআপ করা জন্য সিনিয়রদের বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। টিম হিসেবে ভালো খেললেই দল সাফল্য পাবে।
সবশেষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির কথায় ফিরি। ফাইনালে ভারত ফেভারিট। বিরাট, শুভমানরা যে ফর্মে আছে ভারতকে এগিয়ে রাখা ছাড়া উপায় নেই। আশা করব, দুবাইয়ে আরও একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত অপেক্ষা করছে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য…