- কল্যাণ গোস্বামী
রোহিঙ্গা যেন আতঙ্কের এক নাম। প্রায়ই প্রচার চলে, দলে দলে রোহিঙ্গারা ছেয়ে যাচ্ছে ভারতে। পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যেভাবে বলেন, তাতে মনে হয়, এই রাজ্যের আনাচকানাচ রোহিঙ্গায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। কোটি কোটি রোহিঙ্গা। বাস্তব ছবিটা কী? রোহিঙ্গা কারা? আসলে কত সংখ্যায় তাঁরা ভারতে বা বাংলায় আছেন? একবার দেখে নেওয়াই যাক না!
অনুপ্রবেশের উৎস
বিশ্বের সর্বাধিক নির্যাতিত রাষ্ট্রহীন সংখ্যালঘু ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বার্মার সরকার (১৯৮৯ সাল থেকে যে দেশের পরিচয় মায়ানমার নামে) রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলিকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। গত শতাব্দীর সাতের দশক থেকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দমনপীড়ন অত্যাচার হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের প্রতিবেশী দেশগুলিতে (বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া) পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচসি) রিপোর্ট অনুসারে, ২০১২ সাল থেকে ১ লাখ ৬৮ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মায়ানমার থেকে পালিয়ে গিয়েছেন। প্রথমে তাঁরা বাংলাদেশের দিকে রওনা হন। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। বিশেষ করে কক্সবাজার জেলায় বেশ কয়েকটি শিবিরে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
২০১৭ সালের অগাস্টের শেষদিকে আরও ১০ লাখ লোক বাংলাদেশে পালিয়ে এলে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহনশীলতা, সহমর্মিতা দেখিয়েছিল। কিন্তু পরে পিছিয়ে যায়। সেই কারণে বহু রোহিঙ্গা থাইল্যান্ডের দিকে রওনা দেন। থাইল্যান্ডের নৌবাহিনী তাঁদের খাবার ও ওষুধ দেয়, কিন্তু নিজেদের এলাকায় ঢুকতে দেয়নি।
মালয়েশিয়াও থাইল্যান্ডের মতো রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়। ইন্দোনেশিয়া ঢোকার সমস্ত পয়েন্ট বন্ধ করে দিলে বহু রোহিঙ্গা শেষমেশ ভারতে পাড়ি জমান!
ভারতে সমস্যা
ইউএনএইচসি-এর হিসেবে ভারতে ২০,০০০ রোহিঙ্গা এসেছেন। তবে ২০১৭ সালে ভারত সরকারের সর্বশেষ অনুমানে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার মতে সংখ্যাটি ২০-২৫ শতাংশ কমবেশি হতে পারে। কোনওভাবেই তার বেশি নয়! ভারতে যে রোহিঙ্গারা এখন আছেন, তাঁরা হয় আগে মায়ানমারে নিপীড়নের শিকার, না হয় বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে চলে এসেছেন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে অন্তত ১৬,০০০ রোহিঙ্গা এসেছেন, যাঁদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ থেকে।
রোহিঙ্গা সমস্যায় ভারতীয় কূটনীতি ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত উভয় সংকটে ছিল। বাংলাদেশ ও মায়ানমার- দুটি দেশই ভারতের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী। ভারত তাই দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৭ সালে মায়ানমার সফরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে নীরব ছিলেন। রাখাইনের অবস্থা বা মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যখনই মায়ানমারের বিরুদ্ধে পশ্চিমী দেশগুলো কোনও প্রস্তাব এনেছে, ভারত তখনই তার বিরোধিতা করেছে।
তবে শেষে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের দাবি মেনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ভারত মুখ খোলে এবং পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালে ভারত সরকার এদেশে ঠাঁই নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠাতে শুরু করে। কিছু রোহিঙ্গা ভয়ে নিজেরাই বাংলাদেশে ফিরে যান। ২০১৮ ও ২০১৯- এই দুই বছরে ১৩০০ থেকে ১৪০০ জন বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছেন। যাঁদের অনেকের কিন্তু ইউএনএইচসি-এর পরিচয়পত্র ছিল।
এখন বিজেপির বদান্যতায় সারা দেশে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম ও মেঘালয়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী শব্দটি কথায় কথায় ব্যবহার করলে হিন্দু বাঙাল কিংবা মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলেই বিজেপি নেতারা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী এবং মুসলমান বিদ্বেষী রাজনৈতিক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে ‘রোহিঙ্গা’ বা ‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করছে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে র্যাশন ও অন্যান্য সুবিধা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন বাংলাদেশি এবং বিদেশি মিডিয়া সময় সময় বাংলাদেশের শিবিরে রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা তুলে ধরেছে। ফলে ভারতে রোহিঙ্গাদের প্রথম গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে ত্রিপুরায় আগরতলা, উদয়পুর এবং ধর্মনগর শহর। এই শহরগুলির বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে দরিদ্র পাড়া ও বস্তিতে রোহিঙ্গাদের বসবাস।
রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় গন্তব্যস্থান অসম। অসম এখন দিল্লি, মুম্বই বা কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের করিডর হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
সত্যিই কি বিপজ্জনক?
ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টকে বছর কয়েক আগে লিখিতভাবে জানিয়েছে, প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে বসবাস করছেন এবং তাঁদের কারণে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। রোহিঙ্গারা যেখান থেকে এসেছেন, সেদেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের প্রমাণ রয়েছে। তাই ভারত সরকার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের তাঁদের দেশ মায়ানমারে ফিরিয়ে দিতে চায়।
এই মুহূর্তে রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী পরিচয়পত্র পাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার। এছাড়াও আরও প্রায় ৫০০-৭০০ রোহিঙ্গা বেআইনিভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে আটক রয়েছেন বিভিন্ন জেলে। ভারত সরকারের হিসেব অনুযায়ী ২০-২৪ হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছেন। মিশে গিয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে।
ভারতে যে সংখ্যায় রোহিঙ্গা আছেন, তাঁরা সবাই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে ধারণাটা অবাস্তব ও অলীক কল্পনা বলে মনে করেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশ্লেষক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার সংবাদ সংস্থা বিবিসি-কে এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, পৃথিবীর সব দেশই চিরকাল এই স্ট্র্যাটেজি নিয়ে চলে যে, যাঁদের দেশে থাকতে দেওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয়, তাঁদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থের পরিপন্থী বলে দেখানো হয়।
যে কোনও সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগ থাকতেই পারে। অপারেশন সিঁদুরের পর সরকার বহু হিন্দু কিংবা সেনাবাহিনীর এমন কয়েকজন জওয়ানের হদিস পেয়েছে, যাঁরা দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন বলে অভিযোগ। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও কেউ কেউ বিপথে গিয়ে থাকতে পারেন। কিছু মানুষকে বিভিন্ন ইসলামি মৌলবাদী সংগঠন বিপথে পরিচালিত করে থাকতেও পারে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
রাষ্ট্রসংঘের মতে, রোহিঙ্গারা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে বৃহৎ রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী, যাঁরা নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এই অবস্থায় যাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, তাঁদের দু’-চারজন বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠীর দিকে আকৃষ্ট হয়ে থাকতেই পারেন। কিন্তু সবাইকে জঙ্গি বলে মনে করার পেছনে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাবনা আছে। রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচিতি এই ভাবনার উৎস।
মোদ্দা কথায় কমবেশি ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন ভারতে। তাঁরা এদেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারেন, এমন ভাবনা অতিরঞ্জন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! অথচ ঐতিহাসিক সত্য হল, রোহিঙ্গারা অবিভক্ত বাংলা থেকে কয়েক শতাব্দী আগে গিয়ে মায়ানমারের আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের একটি বড় অংশ পর্তুগিজ ও মগ দস্যুদের দ্বারা বাংলা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের বংশধর।
আরাকান রাজসভার দুই প্রখ্যাত বাঙালি কবি দৌলত কাজি ও আলাওল এভাবেই আরাকানে গিয়েছিলেন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিন্তু শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু ও বৌদ্ধও আছে। হিন্দু রোহিঙ্গাদের পদবির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের পদবির কোনও পার্থক্য নেই। সেই অর্থে রোহিঙ্গারা তিনশো বছর আগে এদেশেরই অধিবাসী ছিলেন। রাজনীতি এবং ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান নেই।
(লেখক ভারতীয় কৃষি রসায়ন সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল)