কংগ্রেসে থেকে বিজেপির হয়ে কাজ করছেন- এমন নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারের বার্তা দিয়েছেন রাহুল গান্ধি। সম্প্রতি গুজরাটে তাঁর ওই বক্তব্যে সেই রাজ্যের কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি কানাঘুষো শুরু হয়েছে অন্য প্রদেশ কমিটি, এমনকি এআইসিসির অন্দরে। বিজেপি-আরএসএসের প্রতি সহানুভূতিশীল কংগ্রেসিদের জন্য দলের দরজা বন্ধ করার বার্তা স্পষ্ট রাহুলের কথায়।
অনেকদিন থেকে তিনি বলছেন, দেশে দুটি মতাদর্শের লড়াই চলছে। একটি কংগ্রেসের, অন্যটি আরএসএসের। বিচারধারার এই লড়াইয়ে তিনি কোনওরকম আপস করবেন না বলেও বারবার সোজাসাপটা ভাষায় মন্তব্য করেছেন তিনি। কংগ্রেসের মধ্যে থেকে বিজেপি-আরএসএসের লোকদের সরানোর বার্তা ওই আপসহীন মানসিকতার লক্ষণ। রাজনীতিতে একটি দলে থেকে অন্য দলের হয়ে কাজ করার অর্থ নিজের দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, সেই দলের মতাদর্শের সঙ্গে প্রতারণা।
বামপন্থী হোক কিংবা দক্ষিণপন্থী, প্রতিটি রাজনৈতিক দল কোনও না কোনও মতাদর্শের ভিত্তিতে চলে। কংগ্রেস এবং বিজেপি দুটি একেবারে ভিন্ন মতাদর্শের অনুসারী। কিন্তু আর্থিক উদারীকরণের যুগে দুটি দল যে মতাদর্শগতভাবে ভিন্ন মেরুতেই অবস্থান করছে, সেটা মানুষের মধ্যে বিভ্রম আছে। মানুষ, এমনকি বহু রাজনৈতিক দল ভুলে যায় যে, কংগ্রেস ও বিজেপির ডিএনএতে আকাশপাতাল পার্থক্য।
রাহুল সেই বিস্মৃত ভাবনাটিকে লোকচক্ষুর সামনে আনতে অনেকদিন থেকে মরিয়া। হিন্দু ভোটব্যাংকের স্বার্থে এতদিন দ্বিধায় ভুগলেও হাত শিবির এখন রায়বরেলির সাংসদের ভোকাল টনিকে খোলামেলাভাবে বিজেপির সঙ্গে আরএসএসেরও বিরুদ্ধাচরণ করছে। গুজরাটে কংগ্রেসে থেকে বিজেপির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের তাড়িয়ে সেই বিরোধিতাকে আরও চরমে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা স্পষ্ট।
যদিও তাতে কংগ্রেসের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিলুপ্তি ঘটবে কি না, তা অনিশ্চিত। রাজনীতিতে তাঁর উত্থানের প্রথম দিকে অবশ্য সংঘ পরিবারের সমালোচনার পাশাপাশি রাহুল ভারতের সনাতন ধর্ম ও সংস্কৃতি যে বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্ব থেকে আলাদা, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি প্রশ্নচিহ্ন থাকছে। রাহুল, প্রিয়াংকা গান্ধিরা প্রায়ই মন্দির দর্শন করেন। পুজোপাঠেও অংশ নেন। ভোটের সময় সেসব ছক কষে প্রচারের আলোয় আনা হয়। সংঘের হিন্দুত্বের মোকাবিলায় কংগ্রেসের অনেক নেতা-কর্মী আবার নরম হিন্দুত্বের রাস্তায় হাঁটেন। এই কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে কংগ্রেস, বিজেপির দুস্তর ফারাকটা তেমন থাকে না।
অথচ জওহরলাল নেহরু বা সুভাষচন্দ্র বসুরা কোনওদিন ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে রাজনীতি করেননি। তাঁদের চিন্তাভাবনায় বরাবরই ছিল বিজ্ঞানমনস্কতা, সমাজতন্ত্র, বহুত্ববাদের প্রতিফলন। রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মীয় ভাবনাকে দূরে রেখে ভারতকে আধুনিক, উদারমনস্ক গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখাতেন তাঁরা। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন বলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একের পর এক শিল্প-কারখানা, বাঁধ, বিদ্যুৎ প্রকল্প, আইআইটি, আইআইএম, গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন।
ওই ভাবনাচিন্তা ক্রমশ রাজনীতিতে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। রাহুলের কথায় নেহরুর জীবনদর্শনের ঝলক থাকলেও তাঁর কথায় ও কাজে বারবার স্ববিরোধিতাও চোখে পড়েছে। কংগ্রেসের সাংগঠনিক সমস্যাগুলি তিনি খুঁজে বের করতে সমর্থ হলেও তার সমাধানের পথ বাতলে দিতে এখনও পুরোপুরি সফল হননি রাহুল। এই প্রেক্ষাপটে গুজরাটে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে মানুষের কাছে সবার আগে আস্থা অর্জন করতে তাঁর বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ।
এই আস্থা অর্জনে শুধু গুজরাট নয়, বিভিন্ন প্রদেশে অনেক পিছিয়ে আছেন কংগ্রেস নেতারা। যে কারণে রাহুলকে বলতে হয়েছে, কংগ্রেস যেদিন মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে পারবে, সেদিন হারানো জনসমর্থন ফিরে পাবে। ভারত জোড়ো যাত্রা, ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রায় কংগ্রেসকে তিনি কিছুটা জনসংযোগ কর্মসূচিতে ফেরাতে পেরেছেন বটে। কিন্তু কাজটা নিয়মিত না করলে কংগ্রেসের সাইনবোর্ড হওয়া থেকে আটকানো যাবে না। রাহুলের মতো কংগ্রেসের অন্য নেতা-কর্মীরা তা না বুঝলে দলের কোনও ভবিষ্যৎ নেই।