অবশেষে ঘটনার ১৬৫ দিনের মাথায় আরজি কর মেডিকেলের চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় দোষীর শাস্তি ঘোষণা হতে চলেছে। অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে দু’দিন আগে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন শিয়ালদা আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক অনির্বাণ দাস। সঞ্জয়ের বক্তব্য শোনার পর বিচারক সাজা ঘোষণা করবেন বলে সেদিন জানিয়েছিলেন। শোনা হবে নির্যাতিতার বাবা-মায়ের কথাও।
শুধু সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা হচ্ছে জনপরিসরে। বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে, অপরাধের সঙ্গে এক না একাধিক অপরাধীর জড়িত থাকার প্রশ্নটি। অনেকের প্রশ্ন, মেডিকেলের ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চারতলায় চিকিৎসককে যেরকম নৃশংসভাবে ধর্ষণ-খুন করা হয়েছিল, সেটা কি একা কারও পক্ষে সম্ভব?
ঘটনাটির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল সঞ্জয়কে। ওই ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে জুনিয়ার ডক্টরস ফ্রন্টের আন্দোলন অচিরে কার্যত গণ আন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল বাংলায়। যদিও পরে শুধু রাজ্য নয়, এমনকি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের অন্য কয়েকটি দেশেও। পাঁচদিন পর হাইকোর্টের নির্দেশে ঘটনার তদন্তভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। সিবিআই অবশ্য আর কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। বরং গণধর্ষণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছে।
সিবিআইয়ের এই বক্তব্যে আস্থা নেই অনেকের। নির্যাতিতার বাবা-মা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জুনিয়ার ডক্টরস ফ্রন্ট, বিশিষ্টজন, আমজনতার একাংশ মাত্র একজন অপরাধীর জড়িত থাকার তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। যদিও দোষী সাব্যস্ত করার সময় নির্যাতিতার বাবা বিচারককে বলেছিলেন, ‘আপনার ওপর যে ভরসা আমি রেখেছিলাম, আপনি তার পূর্ণমর্যাদা দিয়েছেন।’
কিন্তু অপরাধী একাধিক বলে আগাগোড়াই সওয়াল করছে নির্যাতিতার পরিবার। তাঁদের বক্তব্য, ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় আরজি করের চেস্ট মেডিসিন বিভাগের টয়লেট ভেঙে ফেলায় ৩০ জুনিয়ার ডাক্তার সম্মতিসূচক সই দিয়েছিলেন। বিচারক দোষী সাব্যস্ত ঘোষণা করার সময় অভিযুক্ত সঞ্জয় বারবারই দাবি করে, সে নির্দোষ, বাকিদের ছেড়ে তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। গলায় তার রুদ্রাক্ষের মালা। ফলে এই অপরাধ করলে মালা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত ইত্যাদি ইত্যাদি দাবি শোনা গিয়েছে তার মুখে।
বিচারক জানান, খুন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের সময় মৃত্যু হতে পারে এমন আঘাত করার অপরাধে দোযী সাব্যস্ত করা হয়েছে সঞ্জয়কে। এই অপরাধে দোষীর শাস্তি কী হতে পারে, তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪, ৬৬ ও ১০৩ (১) ধারায় এরকম অপরাধে দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এখন দেখা যাক, বিচারক সঞ্জয়ের বক্তব্য শোনার পর কী সাজা ঘোষণা করেন।
তবে সঞ্জয়ের শাস্তি ঘোষণা হয়ে গেলেও আরজি কর মেডিকেলে ওই ঘটনাটির মামলা চলতেই থাকবে। কারণ, ওই ঘটনায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের মামলা চলছে মেডিকেলের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলের বিরুদ্ধে। ওই দুজনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করতে পারে সিবিআই। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টেও মামলা চলছে।
নির্যাতিতার বাবা-মা হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্ত চেয়ে শীর্ষ আদালতে যে আবেদন করেছেন, শিয়ালদা আদালতে সাজা ঘোষণার দিন সেটিরও শুনানির সম্ভাবনা। অপরাধটির পিছনে জড়িত সব মাথাকে গ্রেপ্তারে যতদূর যেতে হয়, তারা যাবে বলে এখনও অনড় নির্যাতিতার পরিবার।
যদিও সঞ্জয়ের আইনজীবী বিশ্বাস করেন, ফরেন্সিক ল্যাবের রিপোর্ট আদালতে জমা পড়লে মামলা অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। বহু বছর আগে নিউ আলিপুরের অভিজাত আবাসনে কিশোরী হেতাল পারেখকে ধর্ষণ-খুনে কেয়ারটেকার ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে ফাঁসিতে ঝোলানো ভুল হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। তেমনই আরজি কর কাণ্ডে সঞ্জয় সত্যিই একা দোষী নাকি আরও অনেক মাথা জড়িত, তার ওপরেই নির্ভর করছে ধনঞ্জয়ের পরিণতির পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না।