রূপায়ণ ভট্টাচার্য
ওই যে বল এবং ব্যাটের ছবি লাগানো মনঘুড়ি, তার সুতোটি রয়েছে ওই দুটি হাতেই। বলো বলো ক্রিকেটমাই কি জয়…।
বাংলা ক্রিকেটটা চলে নবান্নের মুখ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে আর জাতীয় ক্রিকেট আজ চলে নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘর থেকে। যে যা মনে করুন, এটাই এখন চরমতম বাস্তব।
এবং ক্রিকেট খেলাটা রাজনীতির কাদায় মাখামাখি হচ্ছে কর্তা-নেতাদের যুগলবন্দিতে। তাকে চেনা যাচ্ছে না।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তৃতীয় দফায় (দাদা স্নেহাশিস প্রেসিডেন্ট হওয়ায় বকলমে সৌরভই ছিলেন সুপার প্রেসিডেন্ট) সিএবি প্রেসিডেন্ট হলেন। তিনি আসায় বাংলা ক্রিকেটের কী উন্নতি হয়েছে কেউ বলতে পারবে না। প্রচুর টাকা খরচ করে ভিশন-২০২০ হয়েছিল এবং সেখানে ভিড় করেছিলেন বিদেশি বহু তারকা। ব্যর্থ তাঁরা পকেট ভরা ডলার নিয়ে ফিরে গিয়েছেন, বঙ্গক্রিকেট সেই তিমিরেই।
সৌরভের বদলে অন্য কোনও প্রেসিডেন্ট থাকলে মিডিয়া নানা প্রশ্ন তুলতই। এত টাকা খরচ করে কী লাভ হল? ঋদ্ধিমান সাহার পরে কোনও বাঙালি ভারতীয় দলে এল না কেন? সিএবিতে কেন এত দুর্নীতির ঢেউ?
মোদি-মমতাকে অপ্রিয় প্রশ্ন করে না সাংবাদিক মহল। সৌরভকেও বাংলার সাংবাদিকরা অপ্রিয় প্রশ্ন করেন না।
কলকাতার পথঘাটে বহু ক্রিকেটারের কোচিং ক্যাম্পের দেখা মেলে। এগুলো আসলে অ্যাকাডেমি বলে চালানো হয়। সরকারকে নামমাত্র টাকা দিয়ে ব্যবসা চালান এঁরা। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, অরুণ লাল, অশোক মালহোত্রা, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব রায়— অনেকেরই আছে কোচিং ক্যাম্প। বলুন তো, ক’টা জাতীয় দলের ক্রিকেটার এখান থেকে উঠল এত বছরে? উত্তর আপনারা পাবেন না!
কলকাতা ফুটবলকে যেমন মেরে ফেলা হয়েছে স্থানীয় লিগের বারোটা বাজিয়ে, লিগ ক্রিকেটের অবস্থাও হরেদরে সমান। সৌরভ এতদিন বঙ্গক্রিকেটের শীর্ষে থেকেও সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। পারার কথাও নয়। তাঁর প্রচুর কাজ! আর তাঁকে ঘিরে সব জো হুজুর, ধান্দাবাজের দল। কেউ তাঁর ভুল ধরাতে যান না।
দেশে তিনিই বোধহয় একমাত্র ক্রিকেটার, সব ধরনের কাজ করেন! শিল্পপতি, ফ্যাশন আইকন, মডেল, ধারাভাষ্যকার, কোচ, প্রশাসক! একজনের পক্ষে সবদিক সামলানো মুশকিল! এবং সিএবিতে এটাই হয়েছে, আবার হবেও! দু’তিনজনকে দায়িত্ব দেবেন তিনি! অধিকাংশই অপদার্থ! হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে হাতে মাথা কাটবেন! ঋদ্ধিমানের মতো ক্রিকেটারকেও বাংলার বাইরে পাঠিয়ে দেবেন!
সিএবি-তে যে টিম নিয়ে সৌরভ ফের ঢুকলেন, তা বোঝায় বঙ্গক্রিকেটের শতচ্ছিন্ন দশা। জো হুজুরে ভরে গিয়েছে চারদিক। প্রায় হারিয়ে যাওয়া বাবলু কোলেকে সচিব করলেন সৌরভ, গোষ্ঠী রাজনীতিতে ভারসাম্য রাখতে। সৌরভের অত সময় নেই, সংস্থা চালাবেন কোষাধ্যক্ষ তাঁর প্রিয়তম বন্ধু সঞ্জয় দাস। সংস্থায় এমন দুর্দশা, যেখানে সেখানকার কর্তার হোটেলই ব্যবহার করে সিএবি। কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে বহু পরে। অবাক লাগল, সিএবি বার্ষিক সভায় অন্যবারের মতো ভিনরাজ্যের কিংবদন্তি ক্রিকেটারকে না এনে এনেছিল ফিরহাদ হাকিমকে। কেন? অমিত শা’র সঙ্গে ভবিষ্যতে কথা চালাতে হবে বলে ব্যালেন্সের খেলা? সেখানে উঠল জয় বাংলা, অরূপ বিশ্বাস জিন্দাবাদ, ববি হাকিম জিন্দাবাদ জয়ধ্বনি। হায়, বাংলা ক্রিকেট!
ঠিক একই দুঃসহ ছবি ভারতীয় বোর্ডের। এশিয়া কাপে পাকিস্তান ইস্যুতে নাটকটা বলে দেয়, বোর্ডে কেমন রাজনীতিকরণ, গৈরিকীকরণ চলছে। সূর্য যাদব পাক ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলাবেন না, এটা অবশ্যই বোর্ডের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। বিশেষত, যে বোর্ডে আজ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং অপরিচিত সচিব। আইসিসিতে থেকেও লজ্জাহীন জয়বাবু পিছন থেকে ভারতীয় বোর্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। পরামর্শদাতা অবশ্যই তাঁর পিতৃদেব।
পাকিস্তানের সঙ্গে খেলব অথচ ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলাব না, এর চেয়ে সুবিধাবাদী ভাঁওতাবাজি আর কিছু হতে পারে না। খেলার মাঠে দেশপ্রেম দেখাতে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে খেলাই উচিত ছিল না। আর খেলা যখন হলই, তখন বিপক্ষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলাতে দোষটা কোথায়? তাঁরা তো আর পহলগামে আক্রমণ করেননি!
এ কেমন খেলা, একদিকে তুমি জাতীয়তাবাদের ধ্বজা উড়িয়ে খেলতে চাইছ না, অন্যদিকে প্রচুর টাকা লোকসান হবে বলে আইসিসি টুর্নামেন্টে খেলছ। এর থেকে দ্বিচারিতা আর হয় না। রোজগারও হল, আবার বিদ্রোহও হল।
খেলা ও রাজনীতি মেশানো উচিত না একেবারেই। পাকিস্তান নিয়ে বোর্ড-সরকারের মনোভাবটাই চূড়ান্ত হাস্যকর। বিদেশে ওদের সঙ্গে খেলব কিন্তু পাকিস্তানে যাব না, এখানে আসতে দেব না! হকি খেলব, কাবাডি খেলব, টেনিস খেলব, ওই দলগুলো ভারতে আসবেও! শুধু ক্রিকেটে অন্য নিয়ম! কেন? ক্রিকেট দেখিয়ে ধর্মান্ধ জনতাকে উত্তেজিত করা যায় বলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থাও ভারতের তাঁবেদার বলে শাস্তির সম্ভাবনা নেই!
ক্রিকেটে ধনী ভারত যা করে গরিব পাকিস্তানকে নিয়ে, তা হকি-ফুটবল-টেনিস বা অলিম্পিকে করলে ভারতীয় জাতীয় সংস্থা সঙ্গে সঙ্গে সাসপেন্ডই হত। ফিফা, এফআইএইচ, আইওসি-তে ট্যাঁ-ফোঁও চলবে না। ক্রিকেট প্রশাসনে ভারতের অন্তহীন দাদাগিরি আন্তর্জাতিক স্তরে, তাই এমন হাস্যকর দৃশ্য দেখি।
দূর অতীতে শঙ্করীপ্রসাদ বসুরা যখন ক্রিকেট নিয়ে লিখতেন, তখন বারবার বলতেন, রাজার খেলা ক্রিকেট। সেই রাজার খেলা ক্রিকেট এখন রাজনীতির খেলা। অবশ্যই ভারতে। আর কোনও বড় শক্তিধর দেশে নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজে তো খেলাটা উঠে গিয়েছে। জিম্বাবোয়েতেও তাই। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডেও ক্রিকেটের তুলনায় জনপ্রিয়তায় অনেক খেলা এগিয়ে। অত অর্থ নেই সে সব দেশের ক্রিকেটে।
ভারতীয় ক্রিকেটে অর্থ রয়েছে বলে নেতাদের মাছি ভনভন করে প্রথম থেকেই। অতীতে পাওয়ার, সালভে, রণবীর সিংরা রাজনীতি করলেও সেভাবে রাজনীতি-ক্রিকেট মিশিয়ে দিতেন না। মোদি-শা জমানায় যা হচ্ছে। আমরা তো ভুলিনি বিশ্বকাপের আগে কীভাবে হঠাৎ ভারতীয় টিমজার্সি বিজেপি স্টাইলে কমলা হয়ে গেল। ক্রিকেটাররাও যা দেখে বিশ্বাস করতে পারেননি।
শা আবার বৈঠক করছেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট বানাতে। এটা কি তাঁর কাজ? সেখানে দাবিদার সৌরভ, হরভজন ও প্রাক্তন স্পিনার রঘুরাম ভাট। এর আগে খেলার যাবতীয় নিয়ম বিসর্জন দিয়ে নবান্নে মমতা সৌরভকে সিএবি প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধরে শেষমুহূর্তে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হন সৌরভ। ব্রিজেশ প্যাটেলকে শেষ মিনিটে মসৃণ ল্যাং মেরে। সেটাও একইরকম বেআইনি ঘোষণা। এবার সৌরভ ফের বোর্ড প্রধান হলে বাংলার সিংহাসন আবার ফাঁকা থাকবে। সৌরভ সেখানে কাকে বসাবেন, এটা নিশ্চিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন মমতা। হায় রে ক্রিকেট, রাজনীতিবিদরাই সব ঠিক করে দিচ্ছেন এখানে।
বঙ্গসেরা আইকন সৌরভ বিজেপি-তৃণমূল দুটোর সঙ্গে ব্যালেন্স রাখার খেলায় অতুলনীয়। যেমন সিপিএম ক্ষমতা থাকার সময় তাদের থেকে অনেক কিছু নিয়েছেন। এই ধরনের কাজ কোনও নেতা করলে তাঁকে ধুইয়ে দেওয়া হত। তুমি ধান্দাবাজ, তুমি ক্ষমতালোভী। সৌরভকে কিছু বলা যাবে না। কেননা তাঁর হয়ে বলার জন্য ময়দানে অলিখিত ‘সৌরভ বাঁচাও কমিটি’ রয়েছে। তাঁর এইসব দ্বিচারিতা, অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে বলবে কে?
খেয়াল করে দেখুন, বোর্ডে এই চরম শূন্যতার মাঝেও এত রাজনীতি, এত ধান্দাবাজি দেখে সৌরভের সমসাময়িক কোনও তারকাই ক্রিকেটের প্রশাসনের দিকে যাননি। সৌরভ কেন ফের যাচ্ছেন কে জানে! এতদিনে নিশ্চয়ই আমাদের মতো তিনিও জেনে গেছেন ভালো খেলোয়াড় হলেই ভালো প্রশাসক হওয়া যায় না। প্রকাশ, গাভাসকর, পারগত, ঊষা, আদিল শুমারিওয়ালা, দিলীপ তিরকে সবাই ব্যর্থ।
বোর্ড প্রেসিডেন্ট হতে সৌরভের এমন প্রাণপাত করা উচিতই নয়। পুতুলনাচ তো নাচতে হবে বাবা শা-ছেলে শা’র হাতে! বাবা-ছেলের কোনও লজ্জা নেই প্রশাসনকে ব্যবহার করতে। লজ্জা নেই বলেই আহমেদাবাদের মোদির নামে বৃহত্তম স্টেডিয়াম হয়ে যায়। লজ্জা নেই বলেই আহমেদাবাদকে অলিম্পিকের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
দেশের বিভিন্ন রাজ্য ক্রিকেট কর্তার মাথাদের দিকে তাকান। অধিকাংশই পারিবারিক ও রাজনীতির যোগাযোগে ক্ষমতার শীর্ষে। বোর্ড সচিব দেবজিৎ সাইকিয়া অসমের অ্যাডভোকেট জেনারেল, পদ্মের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ঘনিষ্ঠ। আগে ছিলেন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈর লোক, অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেল। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট রাজীব শুক্লা আদতে কংগ্রেসের, তবে সব পার্টিতেই নোঙর ফেলা ঘোরতর সুবিধেবাদী। চলমান বিস্ময়। রাজা যায়, রাজা আসে। রাজীব ন যযৌ ন তস্থৌ বোর্ডে। এখন যোগী-রাজ্যের ক্রিকেট প্রেসিডেন্ট।
মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট সংস্থার প্রেসিডেন্ট মহানারায়মনরাও সিন্ধিয়া, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার বাচ্চা ছেলে। হিমাচল প্রেসিডেন্ট অরুণ ধুমল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের ভাই। দিল্লির প্রেসিডেন্ট রোহন জেটলি প্রয়াত অরুণ জেটলির ছেলে। মহারাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোহিত পাওয়ার শারদ পাওয়ারের নাতি, বিধায়ক। সৌরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রাক্তন বোর্ড সচিব নিরঞ্জন শাহের ছেলে জয়দেব। বরোদার প্রেসিডেন্ট প্রণব আমিন প্রাক্তন বোর্ড কর্তা চিরায়ু আমিনের ছেলে। গুজরাটের প্রেসিডেন্ট অনিল প্যাটেল জয় শা’র দক্ষিণ হস্ত।
অপেক্ষা করুন, আরও আছে। অন্ধ্রের প্রেসিডেন্ট সতীশবাবু টিডিপি’র রাজ্যসভা সাংসদ। ওডিশার প্রেসিডেন্ট প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আশীর্বাদ বেহরার ছেলে সঞ্জয়, হরিয়ানার প্রেসিডেন্ট অনিরুদ্ধ প্রাক্তন বোর্ড প্রেসিডেন্ট রণবীর সিংয়ের ছেলে। ছত্তিশগড়ের প্রেসিডেন্ট প্রভতেজ ভাটিয়া সিম্বা বিয়ারের মালিক, প্রবল বিজেপি ভক্ত। উত্তরাখণ্ডের প্রেসিডেন্ট প্রাক্তন বিসিসিআই কর্তা মাহিম ভার্মা, যাঁর আমলে ৩৫ লক্ষ টাকার কলা, ১.৭৪ কোটি টাকার ফুড বিল নিয়ে মামলা মোকদ্দমা হয়েছে। বিহারের প্রেসিডেন্ট রাকেশ তিওয়ারি আবার বিহার বিজেপির কোষাধ্যক্ষ।
হয় এঁরা কোনও নেতার ছেলে, নয় ক্রিকেট কর্তার।
আমরা বঙ্গে পরিবারতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র বলে চ্যাঁচাই। অমিত-জয় শা’র পরিবারবাদ নিয়ে সোচ্চার হই। আসল পরিবারতন্ত্রের খেলা চলে ভারতীয় ক্রিকেটে। লক্ষ লোকের ভোট চাই না, জনা দু’তিন নেতাকে রসেবশে রেখে ম্যানেজ করলেই যেখানে রাজসিংহাসন নিশ্চিত।