রাজনৈতিক উপন্যাস বলেছে মানুষের কথাই

রাজনৈতিক উপন্যাস বলেছে মানুষের কথাই

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


 

  • শৌভিক রায়  

সাহিত্যগুণ তেমন নেই বলে উপন্যাসটিকে প্রকাশ করতে চাননি স্বয়ং লেখক। কিন্তু কথা শোনেননি প্রকাশক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাই ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেই থেমে থাকেননি তিনি। উপন্যাসের শেষ কিস্তির পর, ১৯২৬ সালে, কটন প্রেস থেকে, মলাটবন্দি হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’।

প্রকাশের পরেই ‘পথের দাবী’ ঘুম কেড়ে নিয়েছিল তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের। যদিও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় কেন লেখাটি তাদের নজরে এল না, সেটি আজও বিস্ময়। হয়তো উত্তাল সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘উত্তেজক’ উপন্যাসটি নজর এড়িয়ে গিয়েছিল সরকার বাহাদুরের। কিন্তু প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট নড়েচড়ে বসেছিলেন। মূলত তাঁর উদ্যোগে ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় বই।

সময়ের রসিকতা বোধহয় এমনই। যে বই নিয়ে শরৎচন্দ্র নিজে আগ্রহী ছিলেন না, সেটিই অন্যতম ‘বেস্ট সেলার’ হয়েছিল। অনেকে ভাবতে পারেন, বিতর্কিত, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমাদের আকর্ষণ বেশি বলেই বোধহয় এমনটা। কিন্তু সেটা কখনও মূল কারণ নয়। আসলে, এই উপন্যাসে অমর কথাশিল্পী যেভাবে অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, তাতে এটাই হত।

সূর্য সেন, সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ দেশনায়কের আদলে সৃষ্ট, উপন্যাসের নায়ক, সব্যসাচী ছিলেন পরাধীনতার শিকল ভাঙবার মূর্ত প্রতীক। শুধু তাই নয়। সাধারণ মানুষের অবদমিত ইচ্ছেও ফুটে উঠেছিল তাঁর মধ্যে দিয়ে। আসলে আমরা প্রত্যেকেই কোনও কোনও সময় অতিমানব হতে চাই। আমাদের ক্রোধ, হতাশা, আপস সবকিছু নিয়ে এই যে অতি সাধারণ জীবন, সেখান থেকে মুক্তি পেতে চাই। বাস্তবে সেটা কখনোই সম্ভব নয় জানি। তবু মনের গভীরে সেই ইচ্ছে পুষে রাখি। আর সেটিই যেন বাস্তব হয়ে ওঠে কখনও সিনেমার পর্দার বা উপন্যাসের নায়কের হাত ধরে। সেই অর্থে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও ‘পথের দাবী’ অত্যন্ত আধুনিক ও  প্রাসঙ্গিক।

কেননা আমাদের পথের দাবী মেটেনি। এক্ষেত্রে পথ বলতে জীবনের পথকেই বোঝাচ্ছি। উপন্যাসের নামকরণে এটুকু রূপক রেখেছিলেন শরৎচন্দ্র। আজ যদি নিজেদের দিকে তাকাই, তবে সব্যসাচীর সেদিনের রাষ্ট্র থেকে, বর্তমান রাষ্ট্রের খুব কিছু ফারাক দেখি কি? যে শোষণ, অপমান, লাঞ্ছনা সেই পরাধীন দেশে ছিল, তার চাইতে বোধহয় খুব কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। যাদের কঠিন সংগ্রামে দেশে মুক্তিসূর্য উঠেছিল, তাঁদের আমরা ভুলে গিয়েছি। যারা আজ ক্ষমতার অলিন্দে, তাদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা কিন্তু সব্যসাচীর মতো সেইসব মহাপ্রাণ মানুষের জীবনের বিনিময়ে। সাধারণ মানুষ সেদিনও শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়নি, আজও নয়। আজও পথের দাবী তুললে রাষ্ট্রের খাঁড়া নেমে আসে। বলিষ্ঠ লেখনীকে কারারুদ্ধ করা হয়। ছিনিয়ে নেওয়া হয় আদিবাসীদের স্বভূমি। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ক্রমাগত চলে অত্যাচার। কৃষক জমি হারায়, শ্রমিকদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়, বিনা নোটিশে লক আউট হয়, ছিনিয়ে নেওয়া হয় ন্যূনতম অধিকারটুকু। এমন নয় যে, স্বাধীনতার সুফল কিছুই পাইনি। কিন্তু সেটা হয়তো উনিশ-বিশ। তাই আজও বহু বরিষ্ঠ মানুষ, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, চাপা গলায় বলেন, ‘এর চেয়ে ইংরেজ আমল বোধহয় বেশি ভালো ছিল।’

এই দ্বন্দ্ব কিন্তু উপন্যাসের পরতে পরতে। দেখতে পাচ্ছি, উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র অপূর্ব সাধারণ একজন মানুষ। সব্যসাচী তাকে আকর্ষণ করলেও সে দোটানায় ভোগে। আসলে পুরোনোকে বিদায় দিয়ে নতুন কিছু আনতে হলে যে সাহস ও মানসিকতা দরকার সেটি সাধারণদের থাকে না। তারা গড্ডলিকা প্রবাহে চলতেই অভ্যস্ত। বিশেষ করে পরাধীন দেশের নাগরিকদের কোনও কিছুই যেন স্পর্শ করে না। তাদের কাছে বিপ্লব, স্বাধীনতা, পরাধীনতা ইত্যাদি সবই এক। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে সেই প্রান্তিক মানুষকে সেভাবে পাওয়া যায় না।

সব্যসাচীর ভাবনা এখানেই। কেন সমাজের এই শ্রেণি স্বাধীনতার অর্থ বুঝবে না, কেন শুধুমাত্র উঁচুতলার মানুষই সবকিছু কুক্ষিগত করে থাকবে। উপন্যাসের একশো বছর পরেও একই চিত্র। রাষ্ট্র প্রদত্ত বিভিন্ন সামাজিক সুযোগসুবিধে, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি নিয়ে আজও সাধারণ মানুষের অবস্থান প্রমাণ করে, তাদের সত্যিই কিছু যায় আসে না। আর এই ফাঁকে সমস্ত ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে ছড়ি ঘোরায় তথাকথিত এলিট সমাজ। স্বাধীনতা আন্দোলনের  সেই আমলের থেকে, এই আমলের তাই বোধহয় বিশেষ পার্থক্য নেই।

আসলে মহান লেখকরা ভবিষ্যদদ্রষ্টা হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রক্তকরবী’-তে সেই কবে শিল্পবিপ্লবের কুফল সম্পর্কে বলে গিয়েছিলেন। আজ আমরা সেটা বুঝতে পারছি। একইভাবে প্রান্তিক মানুষের অবস্থান বুঝতে ‘পল্লীসমাজ’-এর লেখক শরৎচন্দ্রের বেশি সময় লাগেনি। সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে যে ছবি তিনি এঁকেছেন, তা আজও এক।

পথের দাবীর নিবিড় পাঠ দেখায় যে, ‘উপন্যাসে তিনটি অভিযোগ রয়েছে- শিল্প শ্রেণির নিপীড়ন, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতীয়দের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ এবং ঔপনিবেশিক প্রশাসন ও তার শিল্পপতিদের নিজেদের লাভের জন্য এশিয়ার সম্পদ লুট করার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।’ পাশাপাশি, নারীদের পথের দাবীও চোরাস্রোতের মতো বয়ে চলেছে উপন্যাসে। কাঙ্ক্ষিত সেই নারী স্বাধীনতা কিন্তু আজও আসেনি। গৃহের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা আর ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সেদিনের মহিলাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়া সহজ ছিল না। তবু সুমিত্রা, ভারতী প্রমুখের মতো চরিত্র আমরা দেখি উপন্যাসে। তাদের অর্গল ভাঙা শুধু সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, নিজেদের বিরুদ্ধেও। যেভাবে দীর্ঘদিন ভারতীয় নারীদের পুতুল সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক দূরে তাদের অবস্থান। কিন্তু পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের পরেও সেদিনও তারা যোগ্য মর্যাদা পাননি। আজও পিছিয়ে আছেন। আসলে এই দেশে খুব সহজেই নারীদের পিছিয়ে রাখা যায়। ব্যবহার করা যায় যেভাবে খুশি।

রাজনৈতিক উপন্যাস হয়েও ‘পথের দাবী’ আসলে সাধারণ মানুষের কথাই বলেছে। তাদের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, আশা, হতাশা, প্রত্যাশা, মুক্তি, আলো আর অন্ধকার ফুটে উঠেছে নিপুণ শিল্পীর দক্ষ হাতে। ক্ষমতার হস্তান্তর হলেও, পথের দাবী আজও এক…অন্তত একশো বছরের খণ্ডিত সময় জুড়ে। বরং আজ সব্যসাচীর বড্ড অভাব। অপূর্বর মতো দোলাচলে থাকা মানুষের ভিড়ে, তিনি হয়তো লুকিয়ে আছেন। এই আশা নিয়েই পথ চলা। কেননা ‘আমরা সবাই পথিক। মানুষের মন্যুষত্বের পথে চলবার সর্বপ্রকার দাবী অঙ্গীকার করে আমরা সকল বাধা ভেঙ্গেচুরে চলব।’ উপন্যাসের এই কথাগুলি শতবর্ষ পার করে, আজও একইরকম প্রাসঙ্গিক।

(লেখক শিক্ষক ও সাহিত্যিক। কোচবিহারের বাসিন্দা)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *