- জয়ন্ত ঘোষাল
ইংরেজি শব্দটি হল ‘স্পাই’। বাংলায় আমরা বলি ‘গুপ্তচর’। স্পাই শব্দটা শুনলেই প্রথমে মনে হয় দেশের বাইরে দেশের জন্য কোন ‘র’-এর এজেন্ট কাজ করছে ‘এজেন্ট বিনোদের’ মতো। সলমন খান কিংবা সইফ আলি খান। তাঁরা সবাই দুর্দান্ত স্পাই। হলিউডে জেমস বন্ডের কথাও তো আমাদের স্মৃতিতে সবসময় সমুজ্জ্বল। তবে রাজনৈতিক গুপ্তচর আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার মধ্যেও পরতে পরতে জড়িয়ে আছে।
স্পাই নানান রকম হয়। স্পাই কাকে বলে? সংজ্ঞা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম, স্পাই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি গোপনে তথ্য সংগ্রহ করেন। সেই তথ্য পৌঁছে দেন ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে। যাকে বলে এসপিওনেজের উদ্দেশ্যে। সেটা নানা স্তরে হতে পারে। সরকারি ক্ষেত্রে, বেসরকারি ক্ষেত্রে, দেশের ভেতর, দেশের বাইরে। তবে গুপ্তচর মানেই সবসময় সরকারি স্পাই নয়। এমনকি বহুজাতিক সংস্থাতেও স্পাই প্রথা কার্যকর হয়। অনেক সময় গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে ডবল এজেন্টও হয়ে যায়। একটা সংস্থায় কাজ করছে গোপনে আরেকটা সংস্থার হয়ে আসলে কাজ করছে। এদের বলা হয় ডবল এজেন্ট।
এখনও মনে পড়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বিজেপির শীর্ষনেতা অরুণ জেটলি কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য রাহুল গান্ধির ঘনিষ্ঠ রাজীব শুক্লাকে বলতেন ‘তোমারা সোচ হামারে সাথ হ্যায়। বিজেপিকে সাথ হ্যায়। অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সাথ হ্যায়। অউর শরীর/বডি কংগ্রেসকে সাথ হ্যায়। গান্ধি পরিবারকে সাথ হ্যায়’। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। রাজীব শুক্লা ক্রিকেট রাজনীতিতে আজও যুক্ত। সেদিনও রাজীব শুক্লা শারদ পাওয়ারের ঘনিষ্ঠ। শাহরুখ খানের ঘনিষ্ঠ। মুকেশ আম্বানির ঘনিষ্ঠ। অটলবিহারী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ। অরুণ জেটলির ঘনিষ্ঠ। আদতে তিনি ছিলেন সাংবাদিক। পরবর্তীকালে রাজনেতায় রূপান্তরিত হলেন। কিন্তু ক্রিকেটে যে বিসিসিআই রাজনীতি করেন সেখানে তিনি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিজেপির শীর্ষনেতাদের সঙ্গে। এমনকি ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর রাজীব শুক্লার সেই স্টেটাস বজায় ছিল। আজও আছে। এখনও বিসিসিআই-এর কর্ণধার অমিত শা’র পুত্র এবং তিনি এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট রাজনীতিরও অন্যতম ব্যক্তিত্ব। রাজীব শুক্লা তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আবার রাজীব শুক্লা আজও রাহুল গান্ধি এবং প্রিয়াংকা গান্ধিদেরও ঘনিষ্ঠ। তাঁর স্ত্রী অনুরাধা বিজেপি নেতা রবিশংকরের নিজের বোন। যিনি প্রাক্তন আইনমন্ত্রী বিশিষ্ট বিজেপি নেতা। এখনও রাজীব সম্বন্ধে বলা যায় যে, তিনি শরীরটা কংগ্রেসে রাখলেও হৃদয়টা যেন বিজেপির কাছেই। এহেন রাজীব শুক্লার ভূমিকাকে কি গুপ্তচরবৃত্তি বলা যায়? শোনা যায় যে রাহুল গান্ধি-প্রিয়াংকা গান্ধি-রবার্ট ভদরার সঙ্গে মোদি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের যতই সংঘাত হোক না কেন, যতই কটুতা হোক, যতই এনফোর্সমেন্ট-সিবিআই হোক! কোথায় একটা যুযুধান দুটো পক্ষের মাঝখানেও কিন্তু এমন ব্যক্তির প্রয়োজন হয় যিনি দুটো শিবিরের মধ্যেই তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তবে কি বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি? ডবল এজেন্ট? গুপ্তচরবৃত্তি? সেদিন দিল্লিতে শুনছিলাম, এই যে ন্যাশনাল হেরাল্ডের মামলা নিয়ে সোনিয়া গান্ধি, রাহুল গান্ধির বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট-সিবিআই পেছনে পড়ে রয়েছে। রবার্ট ভদরার বিরুদ্ধে চলছে ডিএলএফের কেলেঙ্কারি। রাজীব শুক্লা নাকি এখন বিজেপির শীর্ষনেতাদের সঙ্গেও একটা বোঝাপড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। যাতে ঝগড়াঝাঁটি যাই-ই হোক কলহ, সংঘাত, রাজনৈতিক লড়াই, ভোটের লড়াই এসব থাকবেই। কিন্তু ব্যক্তিগত চরিত্র হনন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সিবিআই আর এনফোর্সমেন্টকে ব্যবহার এগুলো থেকে তাঁরা যাতে নিবৃত্ত হন তার জন্য রাজীব শুক্লা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কাজেই শুধু ক্রিকেট নয়। কোথাও একটা সেতুবন্ধনের কাজ করছেন। আবার কংগ্রেসের বহু নেতা তাঁরা রাজীব শুক্লার ওপরে খুব চটা। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, সেতুবন্ধন নয়। আসলে রাজীব শুক্লা হল স্পাই। আসলে তিনি আমাদের সব খবর বিজেপির নেতাদের কাছে পাচার করে দিচ্ছেন। এধরনের লোককে বিশ্বাস করা একেবারেই অনুচিত। এই ধরনের ভূমিকা খুব গোলমেলে, সংবেদনশীল।
আমি যখন দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কভার করতাম তখন পাকিস্তান হাইকমিশন আমাকে আমন্ত্রণ জানাত। পাকিস্তানের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাঁদের বাড়িতে দাওয়াত দিতেন। আমার তৎকালীন সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্তকে বলেছিলাম, এই যে পাকিস্তান আমাকে ঘনঘন নেমন্তন্ন খাওয়ায়, ডাকে। শুধু পাকিস্তান দিবসে নয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমনকি বাড়িতেও বিভিন্ন কূটনীতিক ডাকেন। কূটনীতিকদের কাজই হচ্ছে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা, বুঝতে চাওয়া। সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে তাঁদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। তবে বরুণ সেনগুপ্ত আমাকে বলেছিলেন যে, সেটা খুবই ভালো। সাংবাদিক হিসেবে তুমি নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু একটা লক্ষ্মণরেখা রেখে। বেশি ঘনঘন যেতে থাকলে তখন কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দারাও তোমাকে মনে করতে পারে তুমি পাকিস্তানের এজেন্ট। আর পাকিস্তানের লোকেরা মনে করবে তুমি ভারতীয় এজেন্ট। এই ডবল এজেন্ট ভাবার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং সাংবাদিকতা করলেও কোথাও একটা লক্ষ্মণরেখা রাখতে হয়। তা না হলে সাংবাদিকতা সম্পর্কে ভুল ধারণা অনেকের হতে পারে।
জয়ললিতার সঙ্গে বিজেপির যখন সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে তিনি ধীরে ধীরে এনডিএ-তে যোগ দিলেন। তখন তিনি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী। এআইএডিএমকের সমর্থন আদায় করে সরকার গঠন হল। তখন তামিলনাড়ুতে একজন প্রবীণ সাংবাদিক ছিলেন চো রামস্বামী। তিনি জয়ললিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করতে আদবানি এবং জয়ললিতার মধ্যে সেতু হিসেবে তিনি কাজ করেছিলেন এবং তিনি বিরোধের কাজ নয়, জোড়ার কাজ করেছিলেন। এই বিরোধের বদলে জোড়ার কাজ করলে তাকে কি গুপ্তচর বলা উচিত? সুব্রহ্মণ্যম স্বামী একইভাবে জয়ললিতার সঙ্গে সোনিয়া গান্ধির যোগাযোগ ঘটিয়েছিলেন। অশোকা হোটেলে সোনিয়া গান্ধির চা-চক্রে জয়ললিতার আগমন। সেই দিনটা তো ভোলার নয়! তখন স্বামী সুব্রহ্মণ্যম স্বামী সোনিয়া গান্ধির হয়ে কাজ করেছিলেন। আর আজ সেই সুব্রহ্মণ্যম স্বামী সবথেকে বেশি বিরোধিতা করেন সোনিয়া গান্ধির এবং গান্ধি পরিবারের। ন্যাশনাল হেরাল্ডের মামলা তো সুব্রহ্মণ্যম স্বামীই করেন। সুপ্রিম কোর্টে সোনিয়া গান্ধির বিরুদ্ধে কতগুলো মামলা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। সুব্রহ্মণ্যম স্বামী তাহলে কার স্পাই? কার গুপ্তচর? বিজেপির গুপ্তচর হয়ে সোনিয়া গান্ধির শিবিরে মোল হয়েছিলেন? নাকি সোনিয়া গান্ধির মোল হয়ে বিজেপিতে তিনি ছিলেন। একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বা অস্তিত্বের সংকট এধরনের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনেক সময় হয়ে যায়। শুরুতে হয় না। হয় পরবর্তীকালে। যখন গোটা দেশ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ভারতের বিদেশনীতি, ভারত সরকার যখন ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তখন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী ইজরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। ইজরায়েলের সরকারের সঙ্গে ভারতীয় সাংবাদিকদের দৌত্য করতেন। ভারতীয় সাংবাদিকদের ইজরায়েল সফরের ব্যবস্থা করতেন। আনন্দবাজারের তৎকালীন সাংবাদিক দিল্লি অফিসের ব্যুরো চিফ প্রয়াত সুনীত ঘোষ তাঁর বইতে লিখেই গেছেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী কীভাবে তাঁদের ইজরায়েল সফরের ব্যবস্থা করেছিলেন। ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়েছিলেন। তখন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী খুব সক্রিয় হয়ে ইজরায়েলের কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। অনেকে বলতেন, আসলে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী হল ইজরায়েলের এজেন্ট। এই গুপ্তচরবৃত্তির প্রমাণ থাকে না। অভিযোগ থাকে। তার ভিত্তিতে অনেক গল্পের ডালপালা বিস্তার করে শাহি দিল্লিতে।
রাজনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রয়াত সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিংয়ের আলোচনা করতেই হবে। আজকের প্রজন্মের অনেকেই অমর সিংকে দেখেনি বা অমর সিংয়ের কথা ভুলে গেছে। বড়বাজারের ব্লক কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পরিষদের রাজনীতি করতেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায় তখন ডাকসাইটে ছাত্রনেতা। তার পরে রাজ্য নেতা। তারপর ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। অমর সিংকে দেখেছি তাঁর পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার পরে একটা সময় এল যখন সেই অমর সিং দোর্দণ্ডপ্রতাপ দিল্লির নেতা। তাঁর জনসংযোগ সাংঘাতিকভাবে বিস্তৃত। সেখানে অমিতাভ বচ্চন থেকে সোনিয়া গান্ধি। সোনিয়া গান্ধি থেকে হরকিষেণ সিং সুরজিৎ, প্রণব মুখোপাধ্যায়। কে নেই? মুকেশ আম্বানির ঘনিষ্ঠ। অনিল আম্বানির ঘনিষ্ঠ। তাঁর যোগাযোগের আকাশ সুবিস্তৃত। এখনও মনে আছে সংসদে সেন্ট্রাল হলের আড্ডায় একবার অমর সিং প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে বলেই দিলেন, দেখুন প্রিয়দা একটা সময় ছিল যখন আমি আপনার পেছন পেছন ঘুরতাম। আর এখন দেখুন আমার পেছন পেছনই আপনাদের ঘুরতে হয়। কথাটার মধ্যে একটা অহংকার লুক্কায়িত ছিল। কিন্তু প্রিয়দাও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ অমর এ রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতা। যখন সোনিয়া গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হচ্ছে, হরকিষেণ সিং সুরজিৎ সোনিয়া গান্ধির চা-চক্রে যাচ্ছেন তখন অমর সিংকে সোনিয়া গান্ধি চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানাননি। কিন্তু অমর সিং এতটাই মরিয়া ছিলেন যে তিনি হরকিষেণ সিং সুরজিতের গাড়িতে উঠে পড়েছিলেন এবং সোনিয়া গান্ধির বাড়িতে পৌঁছে গেছিলেন তাঁর ইনভাইটেড গেস্ট হয়ে। সংবাদপত্রের হেডিং হয়েছিল : ‘গ্রেট ক্রাশার অমর সিং’। এই অমর সিং যখন জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার কথা হচ্ছে তখন কখনও এই শিবিরে কখনও ওই শিবিরে ঘুরছেন এবং এখানকার কথা ওখানে গিয়ে বলছেন। ওখানকার কথা এখানে এসে বলছেন। অনেকে অমর সিংকে রাজনৈতিক দালাল বলে অভিহিত করত। সোনিয়া গান্ধি তো বলেছিলেন যে, আমি অমর সিংকে এইজন্য ভেতরে ঢুকতে দিতে চাইছিলাম না, ও কংগ্রেসের কেউ না। অমর সিং স্পাই। অমর সিং কেকে বিড়লার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হিন্দুস্তান টাইমসের মালকিন কেকে বিড়লার কন্যা শোভনা ভারতিয়ার সঙ্গেও ছিল অমর সিংয়ের দারুণ সম্পর্ক। মাধব রাও সিন্ধিয়া পরিবারের সঙ্গে অমর সিংয়ের দারুণ সম্পর্ক।
এই রাজনৈতিক মিডলম্যান তাদের কাজের সঙ্গে রাজনৈতিক গুপ্তচরদের সম্পর্ক আছে। মিল খুঁজে পাওয়া যায়।