রাজধানীতে সাফল্যরেখার আশা ও আশঙ্কা

রাজধানীতে সাফল্যরেখার আশা ও আশঙ্কা

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


 

  • গৌতম হোড়

কোনও সন্দেহ নেই, দিল্লি আলাদা রাজ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার পর রাজধানীর যে রমরমা, চাকচিক্য, তার জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। তিনি হলেন শীলা দীক্ষিত। একসময় উত্তরপ্রদেশের শক্তিশালী কংগ্রেস নেতা উমাশংকর দীক্ষিতের পুত্রবধূ শীলা দীক্ষিত লাগাতার তিনবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৫ বছর দিল্লি শাসন করার পর তাঁকে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে হারতে হয়েছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ১৫ বছর ছিল রাজ্য হিসাবে দিল্লির ক্ষেত্রে স্বর্ণযুগ। রাজধানীর পরিকাঠামোর বিপুল উন্নতি ঘটেছিল তাঁর সময়েই।

শীলা অবশ্য দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী নন। সেই কৃতিত্বটা রয়েছে সুষমা স্বরাজের। তবে অটলবিহারী বাজপেয়ীর আগ্রহে সুষমা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন সামান্য সময়ের জন্য। মাত্র ৫২ দিন। সুষমাকে মুখ্যমন্ত্রী করে বাজপেয়ী একটা রাজনৈতিক ফাটকা খেলেছিলেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। মদনলাল খুরানা ও সাহেব সিং বর্মার ঝগড়ায় ব্যতিব্যস্ত বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব সুষমাকে মুখ্যমন্ত্রী করে ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই ভোটে কংগ্রেস জিতে যায়।

দিল্লির তৃতীয় মহিলা মুখ্যমন্ত্রী অতিশীও বেশিদিন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রবল চাপের মুখে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর অতিশীকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। আবার আপ জিতলে তিনি নন, কেজরিওয়ালই মুখ্যমন্ত্রী হতেন। তাঁকে সামনে রেখেই ভোটে লড়েছিল আপ।

অতিশীর পর দিল্লির চতুর্থ ও বিজেপির দ্বিতীয় মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হলেন রেখা গুপ্তা। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ডের পর দিল্লিতেও আরএসএসের পছন্দের নেতাকেই মুখ্যমন্ত্রী করলেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শা’রা। কেজরিওয়াল প্রথমবার বিধায়ক হয়েই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। রেখাও তাই হলেন। পরপর দু’বার হারের পর তৃতীয় প্রচেষ্টায় বিধানসভায় জিতে আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে তাঁর কাছে স্বপ্নের মতো বিষয়।

মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রথম দিনে তিনটি কাজ করেছেন রেখা গুপ্তা। মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দিল্লির বাসিন্দাদের জন্য আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প চালু করা হবে। দিল্লি সরকার পাঁচ লাখ টাকার টপআপের ব্যবস্থা করবে। আপ-এর আমলে সিএজির যে সব রিপোর্ট পেশ করা হয়নি, তা সব পেশ করা হবে। যার প্রথম রিপোর্টটি পেশ করা হয়েও গিয়েছে। যেখানে সিএজির রিপোর্টে বলা হয়েছে, আবগারি লাইসেন্স নিয়ে কালক্ষেপ করায় কেজরিওয়াল সরকার দিল্লির দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্বের ক্ষতি করেছে। তিন নম্বর কাজটা হল, সন্ধ্যায় যমুনা নদীতে গিয়ে আরতি করেছেন। তিনি বলেছেন, এবার যমুনা পরিষ্কার করার কাজটা শুরু হবে।

অর্থাৎ, প্রথম দিনে রেখা বিজেপির একটি নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন। সেটা হল, আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত।

সিএজি রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ করার রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। প্রধান বিরোধী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে বেকায়দায় ফেলা এবং আপ নিজের দুর্নীতি ঢাকতে সিএজি রিপোর্ট পেশ করেনি, এরকম একটা ন্যারেটিভ তৈরি করা। এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক। আর যমুনাতীরে আরতি করার সিদ্ধান্ত প্রতীকী।

দিল্লিতে এখন যমুনার যা অবস্থা, তাতে এই প্রতীকী ব্যবস্থায় কোনও কাজ হবে না। দিল্লির যমুনার জল ঘোর কালো রংয়ের, কাছে গেলে দুর্গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসতে পারে। জল এতটাই বিষাক্ত যে, কোনওরকম মাছ এখানে বাঁচতে পারে না। সরিতা বিহারের কাছে যমুনায় যে বাঁধ আছে, সেখান থেকে যখন জল ছাড়া হয়, তখন বিষাক্ত ফেনা উড়তে থাকে। দিল্লির প্রধান ২২টি নালার মধ্যে ১৩টি নালার জল সরাসরি পরিশোধন না করে যমুনায় পড়ে।

এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট সম্প্রতি দাবি করেছে, তারা দিল্লি সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে তিন বছরের মধ্যে যমুনাকে দূষণমুক্ত করে দিতে পারবে। তাদের দাবি, কাজটা খুবই কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তবে তার জন্য দিল্লির সব নালার জল পরিশোধন করে যমুনায় ফেলতে হবে, কিছু নালার গতিপথ বদলে দিতে হবে। যমুনার জল ব্যবহার চুক্তির মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে, চাষের জমি থেকে অ্যামোনিয়া ও ফসফেটের মতো যে রাসায়নিক যমুনার জলে মিশছে, তা বন্ধ করতে হবে।

ফলে প্রতীকী আরতি করে খুব বেশিদূর যেতে পারবেন না রেখা। গঙ্গা পরিশোধনের জন্য এত অর্থ, এত প্রতিশ্রুতি, এত প্রয়াসের পরেও দেখা যাচ্ছে, দূষণ এখনও বহালতবিয়তেই আছে। রাজীব গান্ধি থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীদের চেষ্টায় এখনও পর্যন্ত কোনও ফল হয়নি।

রেখা গুপ্তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ, তাঁকে কাজ করে দেখাতে হবে। নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে। কেজরিওয়াল বা আপের আমলে মানুষ যেসব সুবিধা পাচ্ছিলেন, তা বহাল রাখতে হবে। তার ওপর বিজেপি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা পূরণ করতে হবে। সেটা করতে গিয়ে শুরুতেই বিপদে পড়েছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল, তারা ক্ষমতায় এলে দিল্লির আয়কর না দেওয়া মেয়েদের প্রত্যেকের হাতে মাসে আড়াই হাজার টাকা তুলে দেবে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রকল্প চালু করা নিয়ে বৈঠক করেছিলেন রেখা। তারপর তিনি অভিযোগ করেছেন, কেজরিওয়াল পুরো রাজকোষ শূন্য করে দিয়েছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অতিশী বলেছেন, এগুলো আসলে অজুহাত। আপের আমলে দিল্লির বাজেট বহুগুণ বেড়েছে। ফলে রাজকোষে অর্থাভাব হওয়ার কথাই নয়।

রাজনীতিকরা স্বভাবত অন্যের ঘাড়ে দোষ দিতে ভালোবাসেন। কিন্তু রেখার ক্ষেত্রে আপ বা কংগ্রেসকে দায়ী করে খুব বেশি লাভ হবে না। কারণ, অনেক  প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। তাদের সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে। দিল্লি নামে রাজ্য হলেও আসলে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। দিল্লিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের হাতে। দিল্লির জমির দায়িত্ব কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়নমন্ত্রকের হাতে। অফিসার নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রায় সব বিষয়েই এলজির অনুমোদন নিতে হয়।

অতীতে কেজরিওয়াল বারবার বলেছেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যর মতো গুটিকয় বিষয়েই সরকার কাজ করতে পারে। বাকি সব ক্ষেত্রে হয় কেন্দ্রের অনুমতি নিতে হয় অথবা পুরো ক্ষমতাই কেন্দ্রের হাতে। তাই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে রাজনৈতিক মহলে হাফ মুখ্যমন্ত্রী বলা হয়।

শীলার সুবিধা হয়েছিল, তার ১৫ বছরের মধ্যে অনেকটা সময় কেন্দ্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সরকার ছিল। আর বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন দিল্লি সরকারের কাজে বাধা দিয়েছেন এমন অভিযোগ ওঠেনি। এখন কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপি সরকার। বিজেপির বহু বিজ্ঞাপিত ও প্রচারিত ডাবল ইঞ্জিন সরকার কাজ করবে। ফলে কোনওরকম অজুহাত দেওয়ার জায়গা রেখার থাকবে না।

প্রথম কয়েকদিনের মুখ্যমন্ত্রিত্বে রেখা একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, প্রধান বিরোধী দল আপকে তিনি ছেড়ে কথা বলবেন না। প্রথম দিনেই সিএজির রিপোর্ট পেশ তারই একটা ধাপ। এরকম আরও অনেক সিদ্ধান্ত আগামীদিনে দেখা যাবে। গণতন্ত্রে প্রধান প্রতিপক্ষকে ক্ষমতাসীন দল সবসময় চাপের মধ্যে রাখে, এটা এখন স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু পাশাপাশি বিজেপির মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে কাজ করে দেখাতে হবে।

দিল্লির সামনে সমস্যার তালিকাটা বিশাল। সেখানে প্রবল যানজট, গরিব মানুষের দিল্লির উন্নয়ন, বেহাল রাস্তাঘাট ঠিক করা, ফুটপাথ দখল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো করা, বেআইনি নির্মাণ, জল, পার্কিং, গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা, জবরদখল সহ অসংখ্য সমস্যা আছে। আপ ও কংগ্রেসের সময় এখন অতীত। বিজেপির মহিলা মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে প্রতিশ্রুতি পূরণ করে দিল্লির সমস্যা মেটান তার দিকে তাকিয়ে পুরো দিল্লি। সেই চ্যালেঞ্জটা রীতিমতো কঠিন।

ছাত্র রাজনীতি দিয়ে হাত পাকানো, পুরসভার পার্ষদ হিসাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা রেখা এই প্রথম অনেক বড় ক্ষেত্রে কাজ করার দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁর সুবিধা হল, তিনি মোদি-শা এবং এলজির সমর্থন ও সহায়তা পাবেন। আর অসুবিধা হল, প্রত্যাশার চাপ খুবই বেশি। সেই চাপ কাটিয়ে রেখাকে সফল হতে হবে। শীলা দীক্ষিতকে টপকে যাওয়ার কাজটা খুব সহজ নয়।

(লেখক সাংবাদিক)

The put up রাজধানীতে সাফল্যরেখার আশা ও আশঙ্কা appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *