সাড়ে তিন বছর চলার পরেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই। অথচ ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক লড়াই সাড়ে তিনদিন না গড়াতেই বিরতি ঘোষণা হয়ে গেল। কার আন্তরিক চেষ্টায় সংঘর্ষ বিরতি সম্ভব হল, তা নিয়ে যেন বিতর্কের শেষ নেই। যুদ্ধবিরতির কৃতিত্বের দাবিদার অনেক। ঘটনার দেড় মাস পরেও সেই বিতর্ক অব্যাহত।
সম্প্রতি পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের দুটি বিবৃতি এই বিতর্ককে নতুন করে উসকে দিয়েছে। দুজনেরই সুপারিশ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে ভারত এবং পাকিস্তানকে সংঘর্ষ বিরতির সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, তাতে নোবেল শান্তি পুরস্কার তাঁরই প্রাপ্য হওয়া উচিত। যদিও শরিফ-মুনিরের প্রস্তাব নিয়ে খাস পাকিস্তানেই বুদ্ধিজীবী-লেখক-সাংবাদিক মহলে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধবাজ বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর শাগরেদ কোন যুক্তিতে নোবেল শান্তি পুরস্কারের দাবিদার হতে পারেন- এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। হয়তো ট্রাম্পকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পাকিস্তানের এটা চাল হতে পারে। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আগে সংঘর্ষ বিরতির তথাকথিত স্বঘোষিত কারিগরকে নিয়ে আলোচনা করতে হলে গত ১০ মে বিকেলের ঘটনাপ্রবাহে নজর রাখা জরুরি।
পহলগামে হামলার বদলা ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলে ৭ মে ভোররাত থেকে ১০ মে বিকেল পর্যন্ত। সেদিন বিকেলে টিভিতে ছিল দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা- এক) রাত আটটায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণ এবং দুই) সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় ট্রাম্পের সাংবাদিক বৈঠক। এরমধ্যে ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেল যে, হোয়াইট হাউস সূত্রে খবর, ভারত ও পাকিস্তান দু’পক্ষই সংঘর্ষ বিরতিতে রাজি হয়ে গিয়েছে।
সংঘর্ষ বিরতির এই ঘোষণায় দেশবাসী হতভম্ব। সংঘর্ষ হল ভারত-পাকিস্তানের আর সংঘর্ষ বিরতির খবর কি না ঘোষণা করা হচ্ছে আমেরিকা থেকে। স্বভাবতই চরম বিভ্রান্তি। সন্ধ্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্টও সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করলেন, মোদি-শরিফকে তিনিই সংঘর্ষ বিরতিতে রাজি করিয়েছেন এবং তাতে পরমাণু যুদ্ধ ঠেকানো গিয়েছে। দেশবাসী বেশ ধাঁধায় পড়লেন। পাকিস্তানের প্রস্তাবে ভারত রাজি হয়েছে নাকি ট্রাম্পের মধ্যস্থতাতেই হল?
রাত আটটায় মোদি দাবি করলেন, পাকিস্তানই সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। মানুষ আরও বিভ্রান্ত হল। রহস্য আরও ঘনীভূত হল। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগল, পহলগামের বদলা হিসেবে যখন পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার মোক্ষম সুযোগ পাওয়া গেল, তখন ট্রাম্পের কথায় কেন তড়িঘড়ি মোদি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে গেলেন? ভারতের অনেকের মনোভাব ছিল, সুবর্ণ সুযোগ যখন পাওয়াই গিয়েছে, তখন আরও কয়েকদিন লড়াই করে পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনর্দখল করাই উচিত।
তারপরে গত দেড় মাসেও সংঘর্ষ বিরতি নিয়ে চর্চা বন্ধ নেই। মোদি মাঝেমধ্যেই দাবি করেন, পাকিস্তান প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল। ট্রাম্পের পালটা দাবি, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যের টোপ দিয়ে তিনি ভারত ও পাকিস্তানকে লড়াই থেকে বিরত করেছেন। হালে মোদি-ট্রাম্পের দীর্ঘ ফোনালাপ হলেও পরিস্থিতি সেই একই। মোদি যা-ই দাবি করুন না কেন, ট্রাম্প নিজের বক্তব্যে অবিচল।
গত দেড় মাসে সংঘর্ষ বিরতি নিয়ে বহুবার নিজের ঢোল পিটিয়েছেন তিনি। সদ্য শরিফ ও মুনিরের নোবেল প্রস্তাব শোনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট আবারও দাবি করেছেন, তিনিই সংঘর্ষ বিরতির রূপকার। ট্রাম্প-শরিফ-মুনির একরকম বলছেন আর মোদি বলছেন উলটো কথা। তাহলে কোনটা সত্যি? রহস্যের কিনারা হল না। ট্রাম্পকে যতই ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে দাবি করুন মোদি, তাঁর মানসম্মান নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মাথাব্যথা নেই।
সুতরাং বিষয়টি নিয়ে যত তর্জা চলবে, মুখ পুড়বে মোদিরই। বিশ্ব ইতিহাসের বহু রহস্যের যেমন কিনারা হয়নি, ভারত-পাক সংঘর্ষ বিরতির মূলে কে, সেই প্রকৃত সত্যটি হয়তো অজানাই থেকে যাবে।