পার্থ সারথি সিনহা: দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ভিতরের শেষ কথা। সতর্কতামূলক অ্যালার্ম। এবং উড়ানের পথের তথ্য সংরক্ষণ। সবই থাকে ব্ল্যাক বক্সে। আর তাই আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার এআই-১৭১-এর ‘ব্ল্যাক বক্স’-এ। কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা, তা জানতে এখন তাই নজর, দুটি কমলা রঙের মেটালিক বক্সের দিকে। যা আসলে ‘ব্ল্যাক বক্স’ নামে পরিচিত।
বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই ‘ব্ল্যাক বক্স’? সংবাদ সংস্থা জানাচ্ছে, সব প্লেনেই দু’রকমের ব্ল্যাক বক্স রাখা থাকে। এটাই নিয়ম। একটি ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (সিভিআর)। অপরটি ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (এফডিআর)। কোনও দুর্ঘটনা হলে এই দুই রেকর্ডিং থেকে কী ঘটেছিল সেটার একটা ছবি ভেসে ওঠে তদন্তকারীদের সামনে। ফ্লাইট ডেটা রেকর্ড থেকে পাওয়া যায় অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের হিসেব, কোনদিকে যাচ্ছিল বিমান, কত স্পিড ছিল এমন মোট ৮০ রকমের তথ্য পাওয়া যায়।
বিমান দুর্ঘটনা মানেই ধ্বংসাবেশেষ। পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে কেন বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে সমস্যা হয় তদন্তকারীদের। তা হলে উপায় কী? এই জন্যই আবিষ্কার হয়েছিল বিমানের ব্ল্যাক বক্স। এই বক্স আসলে দু’টি কমলা রঙের মেটালিক বাক্স। যার মধ্যে থাকে রেকর্ডার। ১৯৫০ সাল থেকে এই বক্স ব্যবহার করা চালু হয়। কোনও বিমান দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে ঠিক কী কারণে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা আগে বোঝা সম্ভব হত না তদন্তকারীদের পক্ষে। দুর্ঘটনার আগের মুহূর্তে বিমানে কী হয়েছিল তাও জানা সম্ভব ছিল না। তাই এই ‘ব্ল্যাক বক্স’ ব্যবস্থা রাখা হয় বিমানে। প্রথমে মেটালিক স্ট্রিপে রেকর্ড হত বিমানের ভিতরের সব ঘটনা। যাতে জলে কিংবা আগুনের গ্রাসে পড়লেও নষ্ট না হয় তথ্য। পরবর্তীতে উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগনেটিক ড্রাইভ এবং মেমরি চিপ রাখা হয় ব্ল্যাক বক্সে।
রেড থেকে ব্ল্যাক:
১৯৫৩-৫৪ সালে বিমান দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় একটি ডিভাইস তৈরি করার কথা ভাবা হয়েছিল। যাতে সেটি বিমান দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে। সেটি দুর্ঘটনা থেকে বিমানকে বাঁচাতেও সাহায্য করতে পারে। প্রথম দিকে এটি লাল রঙের ছিল এবং ‘রেড এগ’ নামে পরিচিত ছিল। ডিভাইসের ভিতরের দেয়ালগুলি কালো রঙের ছিল, তাই পরবর্তীতে এটি ‘ব্ল্যাক বক্স’ নামে পরিচিতি পায়। ১১ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে বক্সটি। কোথাও হারিয়ে গেলে প্রায় ৩০দিন ধরে ভাইব্রেশনের সঙ্গে জোরে আওয়াজ করতে পারে। প্রায় ২-৩ কিলোমিটার দূর থেকে তদন্তকারীরা এই ভয়েস সনাক্ত করতে পারবেন। সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৪ হাজার ফুট গভীরতা থেকে তরঙ্গ নির্গত করতে পারে।
কীভাবে অক্ষত থাকে ব্ল্যাক বক্স?
বিমান দুর্ঘটনায় যেখানে সমস্ত কিছু কার্যত ভগ্নাবশেষে পরিণত হয় সেখানে এই বক্স বেঁচে যায় কীভাবে। এর প্রধান কারণ হল এটি বানানো হয় স্টিল অথবা টাইটেনিয়াম ধাতব পদার্থ দিয়ে। শুধু তাই নয় ইনসুলেটেড লেয়ার থাকে। যার ফলে জলের মধ্যে কিংবা অতিরিক্ত ঠান্ডায় বা আগুনের প্রচন্ড উত্তাপেও যাতে কিছু না হয়। বিমানের একেবারে লেজের দিকে রাখা থাকে এই বক্স। যেখানে ক্র্যাশের রেশ সবচেয়ে কম পড়ে। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ব্ল্যাক বক্স সাধারণত বিমানের পিছনের দিকে রাখা হয়। এটি টাইটানিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি। একটি টাইটানিয়াম বাক্সে আবদ্ধ থাকে সেটি। এখন স্থলভাগে বা জলভাগে ব্ল্যাক বক্স থেকে ৩০ দিন ধরে আল্ট্রাসাউন্ড সিগন্যাল বেরোতে থাকে যাতে কোনও র্যাডারে তা ধরা পড়ে তদন্তকারীরা খুঁজে পায়। তবে ব্যতিক্রম ঘটনাও আছে যেমন মালেসিয়ান বিমান দুর্ঘটনায় ব্ল্যাক বক্সটি খুঁজেই পাওয়া যায়নি।
ব্ল্যাক বক্সের মধ্যে দুটি আলাদা বাক্স থাকে। ১) ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার: এই বক্সে ফ্লাইটের দিকনির্দেশ, উচ্চতা, জ্বালানি, গতি, টার্বুল্যান্স ও কেবিনের ভিতরের নানা তথ্য থাকে। প্রায় ২৫ ঘণ্টা ধরে ৮০ ধরনের বিভিন্ন ডেটা রেকর্ড করতে পারে এটি। ২) আরেকটি হল ককপিট ভয়েস রেকর্ডার: এই বক্সটি শেষ দুঘণ্টার মধ্যে বিমানের মধ্যে ঘটে যাওয়া শব্দ রেকর্ড করে। ড্রিমলাইনার এআই-১৭১-এর বিপর্যয় রহস্য জানতে হাতিয়ার সেই ব্ল্যাক বক্স।