- শ্যামলী সেনগুপ্ত
বড় উলটো চলছে দিন। আকাশ ছুঁয়ে থাকবে সোনালি আলো, হাওয়ায় মৃদু রং ছড়িয়ে পলাশ কেশর উড়বে, যাওয়া-আসার পথে পথে বিছিয়ে থাকবে মাদার আর শিমূল তবেই না মন আঁকুপাঁকু করবে ‘নিসুলতানা রে, প্যায়ার কা মৌসম আয়া…।’ ফর্সা আকাশে তবেই না শশী কাপুর আর আশা পারেখ মিশিয়ে দেবেন প্রাকৃতিক গুলাল।
দোল চলে গেলেও থেকে যায় রংয়ের রেশ।
তবু বসন্ত ঢুকে পড়ে। তখন ‘বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা’ ফার্লং ফার্লং দূরে। তবু বসন্ত এলোমেলো করে দেয় ফাগুন হাওয়া ও ফাগ। বুদ্ধদেব গুহ মনের ভেতর পুটুর পুটুর করতে থাকেন। একটি দুধ সাদা চিকনকারি বেরিয়ে পড়ে দিদির ট্রাংক থেকে। ছাব্বিশে জানুয়ারির সিভিল প্যারেডে এইটাই পরেছিল শৈলবালা উইমেন্সের শেষ বর্ষের ছাত্রী। আজ বোন পরবে সন্ধেবেলায়। সেই রং অনেক স্মৃতিকাতরতার জন্ম দেয়। যখন সান্ধ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলত সকাল থেকে। বেলকুঁড়ি ভিজিয়ে রাখা হত। মোরাদাবাদী নকশা কাটা পাত্রে গোলাপি আবিরের স্তূপ বানানো হত।
সেই কৈশোর উত্তীর্ণ মলয় বাতাসে গোলাপি আবির বড় প্রিয় ছিল। অথচ তেমন কোনও আহামরি জিনিস নয়। তখনও ফুলের আবিরের চল হয়নি। ওই চকের গুঁড়োর সঙ্গে কৃত্রিম রং মিশিয়ে যে আবির, তারই তখন রমরমা।
হাওয়ায় গুলাল উড়লেই চাঁচরের দিনগুলি ভেসে ওঠে। দোল বলুন আর হোলিই বলুন, চাঁচরের থেকেই তো শুরু আবির ওড়ানো। জন্মসূত্রে ওডিশায় কেটে গেছে জীবনের প্রথম পর্ব, বিবাহ পূর্ববর্তী পর্ব। সেই সে দেশের সেই সে গ্রামে বড় ঠাকুর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। সে মাঠের পাশেই দিয়ে রাস্তা। নাম বড়দাণ্ড। তো সেই মাঠে দোল চতুর্দশীর রাত ঝলমল করত আলোয়, কাগজের পতাকায় আর ফুলের মালায়। বড়ঠাকুর নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন যে! গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে কৃষ্ণকিশোররা আসছেন, একা অথবা শ্রীরাধিকাকে সঙ্গে নিয়ে, দোলায় চেপে। এই ভাবনাতেও কত রং মিশে থাকে।
একবার রং খেলা হল কলকাতার বাঘা যতীনে। মাসির বাড়ি বেড়াতে এসে। যাদবপুরের ফিজিক্স অনেকক্ষণ থেকে লেগপুলিং করছিল। বিজ্ঞানের স্টুডেন্ট জেনে যাদবপুর ফিজিক্স COLOR থেকে শুরু করে জাপানি ভাষার কাবোদাচোতে মুভ করতেই এক ঝাড়। পরেরদিন তার শোধ তুলল চুলে খুনি রং দিয়ে। যত ধারা স্নান, তত লাল রং। তত লাল রং। ‘ইয়ে লাল রং কব মুঝে ছোড়েগা।’
পরের দোলে গোলাপির সঙ্গে লাল আবিরের প্যাকেট এল ঘরে। হাওয়ায় উড়ল লাল দোপাট্টা।
তো, সেবার সেই গ্রামীণ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে কী করে যেন লাল আবির আর মশাল প্রাধান্য পেল। এক নতুন জানার দিক খুলে গেল। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে প্রায় ভস্ম করে দিচ্ছিল এবিভিপি আর সিপির দাদাদিদিরা। তবে এখনকার মতো লাঠালাঠি ধস্তাধস্তি হয়নি। শুধু দেখতাম, বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার ধারে আম বাগানে লাঠি, লেজিম নিয়ে প্রশিক্ষণ চলছে।
রং খেলা একেক জায়গায় একেকরকম। মধ্যপ্রদেশের খারগোন জেলার একটি গ্রাম চোলি। সেখানে হোলির দিন শান্তি বিরাজ করে ঘরে, পথে, ঘাটে। কেউ রং খেলেন না সেদিন প্রাচীন কোনও ঐতিহ্য মেনে। তবে পরের দিন তাঁরা রঙের উৎসব পালন করেন। যে বাড়িটি মৃত্যুর জন্য শোকপালন করছে, সেখানেই গ্রামের মানুষ প্রথমে যান রং দিতে। তাদের শোকপালনে কিছুটা দুঃখ কম করতে। আমাদের বাংলায় কোনও কোনও জায়গায়ও এমন প্রথা আছে।
এই বসন্তে দোল, হোলি, আবির এবং আবিরের রং বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। লাল রং তো শুভ। গোলাপি চিরকাল প্রেমের রং। সবুজ তো প্রকৃতির কথাই বলে। নীল শান্তির প্রতীক। হলুদ রং শুদ্ধতার বর্ণ। আর এখন বেগুনি, গেরুয়া এমনকি শ্বেতশুভ্র আবিরও মিলছে দোকানবাজারে।
তবে কি না ইদানীং রং নিয়ে বড্ড বেশি চিন্তা করতে হয়। গেরুয়া কিনলে এক রাজনৈতিক রঙে, লাল কিনলে আরেক রাজনীতির রঙে, এমনকি সবুজ, গোলাপি সব আবিরই রাঙিয়ে দেয় ভিন্ন ভিন্ন মতের রাজনীতির তকমায়। তাই তো তরুণ প্রজন্মের পছন্দের তালিকায় নিওন-রং। তাদের কেউ বলে রঙের খেলায় রাজনীতি ঢোকানো পছন্দ নয়। তাই পছন্দের আবির গোলাপি, বেগুনি, হলুদ। আবার কেউ বলে, লাল খুব পুরোনো। তাই নিওন-রং। তাই নীল আবির। তাতে সেলফি ভালো ওঠে। সেটা নিয়ে এখন অধিকাংশের বেশি মাথাব্যথা। পোস্ট করতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
দিন এগোবে, আরও নতুন রঙের আবির আসবে বাজারে। যত রং, তত রঙিন হোলি। যেন পুরুলিয়ার গ্রাম! যেখানে লাল, কমলা, হলুদ পলাশের রঙে দেবী-প্রকৃতি ফাগুয়া খেলছেন।
প্রাচীন এক মানব অথবা রীতিনিয়ম মেনে আসা কোনও শুভ্রকেশী বৃদ্ধা কিন্তু এখনও তাঁর রঘুবীরের চরণে লাল আবির ছড়িয়ে দিয়ে জগতের মঙ্গলকামনা করেন। তাঁকে তো ফেলতে পারি না। বাদ দিতেও নয়।