যুদ্ধকে কাজে লাগানোই প্রচারের অঙ্গ

যুদ্ধকে কাজে লাগানোই প্রচারের অঙ্গ

ব্লগ/BLOG
Spread the love


  • শুভাশিস মৈত্র

পহলগামে নিহতদের পরিবারের মানুষের চোখের জল শুকোনোর আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে রাজ্যে রাজ্যে ভোট প্রচারে বেরিয়ে পড়লেন, তাতে এমন সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, সামনের নির্বাচনগুলো শুধু উন্নয়ন আর রাজনৈতিক-হিন্দুত্ব দিয়ে জেতা কঠিন বলে মনে করছে বিজেপি। একটা প্রবল জাতীয়তাবাদী হাওয়াও দরকার তাদের।

সেই প্রচার কর্মসূচিতেই সম্প্রতি পরপর পশ্চিমবঙ্গে আগমন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শা’র। যদিও পশ্চিমবঙ্গে ভোটের এখনও প্রায় এক বছর বাকি।

প্রধানমন্ত্রী পহলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর তাঁরই ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে উপস্থিত না থেকে ভোট প্রচারে বিহার চলে গিয়েছিলেন। তার আগে গিয়েছিলেন রাজস্থানের পাকিস্তান লাগোয়া জেলা বিকানেরে সভা করতে। সেখানে দাঁড়িয়ে  তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান ভুলে গিয়েছিল ভারতমাতার সেবক মোদি এখানে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে’। আর বিহারের মতোই আলিপুরদুয়ারে এসেও তিনি মূলত যুদ্ধের সাফল্য, পাকিস্তানের স্পর্ধাকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া এবং পরের ভোটে বিজেপির জয় নিশ্চিত করার কথা বলেছেন।

ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধকে এইভাবে দলীয় নির্বাচনে ব্যবহার করেননি। যখন তিনি বলেন, ‘মোদি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে’, তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যুদ্ধকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য দাবি করেই ভোট চাইছেন। প্রধানমন্ত্রীর পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকতায় সভা করলেন। নেতাজি ইন্ডোরে তিনি বললেন, ‘দিদি আপনার সময় শেষ, ২০২৬-এ আসছে বিজেপির সরকার।’

বিরোধী শাসিত রাজ্যে এসে যুদ্ধের সাফল্যের সঙ্গে ভোটকে মিশিয়ে এসব কথা যখন বলছেন তাঁরা, ঠিক তখনই কিন্তু বিরোধী সাংসদদের বিরাট দল পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধ-পরবর্তী ভারতের পক্ষে নৈতিক সমর্থন গড়ে তুলতে কাজ করে চলেছেন মোদি সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী। এইরকম একটি পরিবেশে মোদি-শা’র এই ভোট প্রচারের কৌশল শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করে গিয়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে।

একটা সরকার ঠিকভাবে চলছে কি চলছে না বোঝার জন্য নির্বাচনের ফল একটা মাপকাঠি, কিন্তু একমাত্র নয়। বহু সময় দেখা গিয়েছে ভালো কাজ করেও সরকার হেরে গিয়েছে। যেমন ২০০৪-এ অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। বিধানসভায় যেমন ২০০৪-এ অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নাইডু। সিপিএম ক্ষমতায় এসে বেশ কিছু ভালো কাজ করে টানা পরপর ক্ষমতায় ফিরলেও একটা সময়ের পর ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাদের বাঁকা পথ ধরতে হয়েছিল। সেই রাগে বাঙালি এখনও তাদের বিধানসভার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

আবার উলটো দৃষ্টান্তও আছে। যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। অনেক ভালো কাজ করা সত্ত্বেও তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে এই সরকারের কয়েকজন মাথা যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগে জেল খাটছেন, একদল মন্ত্রী যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, শিক্ষকদের চাকরি নিয়ে দুর্নীতি যেভাবে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বাঙালির মনকে বিতৃষ্ণায় ভরে দিয়েছে, তাতে অনেকের মনে হতে পারে ২০২৬-এর তৃণমূল সরকারের পতন হতে পারে। যদিও, অন্তত এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এতকিছুর পরেও তার সম্ভাবনা কম।

তার মানে এই নয় যে বাঙালি তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি সমর্থন করছে। মমতা সরকার যদি চতুর্থবার ফের ক্ষমতায় ফেরে তার প্রধান কারণ হবে, অন্য দলগুলো ভোটারদের সামনে নির্ভরযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের যে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে তার একশো ভাগ দায় পুলিশমন্ত্রী মমতার। তিনি এই ছোট দায়টুকু স্বীকার না করে পহলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলা নিয়ে যখন শা’র পদত্যাগ দাবি করেন, ঠিকই, সেই দাবিতে নৈতিক জোর কম থাকে। কিন্তু, মোদি-শা যখন মুর্শিদাবাদ নিয়ে মমতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান, তখন তাঁরা ভুলে যান ২০০২-এর গুজরাট সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা। যেখানে খুন হওয়া প্রায় ১১০০ জনের মধ্যে ১০০০ জনই ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের ধর্ম দেখে বেছে বেছেই খুন করা হয়েছিল। সেই সরকারের শীর্ষপদে তখন মোদি-শা। ২০২০-র দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসায় ৫০ জনের বেশি মৃত্যু হয়। দিল্লির আইনশৃঙ্খলা অমিত শা’র। সেখানেও নিহতদের ৯৯ শতাংশ সংখ্যালঘু। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের মুখে মুর্শিবাদের কথা শুনতে অনেকেরই আপত্তি থাকবে।

বিজেপি ২০১৪-এ ক্ষমতায় এসেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। গত ১১ বছরে দুর্নীতির সঙ্গে বিজেপি যেভাবে আপস করেছে, তাতে দলের ছবিটাই মলিন হয়ে গিয়েছে। তার ফলেই বিজেপি চাকরি দুর্নীতি নিয়ে লোকদেখানো আন্দোলন ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। কারণ সেই নৈতিক বল বিজেপি অনেকটাই খুইয়ে ফেলেছে। এটাই তৃণমূলকে সুবিধা করে দিচ্ছে।

ব্লকে ব্লকে নানা মাপের অনুব্রত, মাথায় তাদের সরকার এবং পুলিশের হাত, সঙ্গে রাজনীতির রং না দেখে সব মানুষকে অসংখ্য সরকারি প্রকল্পের সুবিধা বিতরণ; তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতার এই মডেল ভাঙতে শুধুমাত্র মুসলিম বিরোধিতা পুঁজি নিয়ে এবং একটা বড় অংশ বাম-কংগ্রেসের মমতাবিরোধী ভোটের সমর্থনে, কোনও সন্দেহ নেই বিজেপি এই রাজ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু এখনও বিকল্প হতে পারেনি।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *