- অনুরাধা কুন্ডা
‘ওঁ জয়ন্তী মঙ্গলাকালী ভদ্রকালী কপালিনী। দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তু তে…দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবী পরমং সুখম। রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো জহি।।’
যাওয়ার আগে মা গো, সৌভাগ্য দাও, আরোগ্য দাও, পরম সুখ দাও…
দশমীর মন্ত্রে মায়ের কাছে চেয়ে নেওয়া সুখটুকু যেমনতেমন সুখ নয়, পরম সুখ। তাকে কেবলমাত্র পার্থিব ভোগসুখের নিরিখে ভাবলে তো হবে না, ভাবতে হবে ত্যাগের নিরিখে, নিমজ্জনের নিরিখে। যে দেবী সকল মঙ্গলের কারণ, তাঁকে বিদায় দিতে বাঙালির চোখ জলে ভাসে। ওই অপরাজিতা দেবীর পুজো শেষ হল, এল ঘট বিসর্জনের মূহূর্ত। আর তার মানেই মা চললেন এক বছরের মতো। ঘট বিসর্জন অর্থ দেবীকে ঘটের অধিষ্ঠান থেকে মুক্ত করা এবং পরবর্তীতে পুনরায় আহ্বান করার প্রস্তুতি।
বাঙালির বিদায় মানে যাই নয়। বাঙালির বিদায় মানে আসি।
একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি…
মেয়ে বিদায়ের প্রথা অনুসরণ করে মা কে বিদায় দেওয়ার ঐতিহ্য হিন্দু বাঙালির সিগনেচার সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটি। আর কোনও ধর্মে গোপাল কোলের ছেলে, উমা ঘরের মেয়ে, শিব ব্যোমভোলা জামাইটি? পারে। বাঙালিই পারে ধর্মীয় আচারকে গার্হস্থ্যের নরম নবনীতে ছেনে ছেনে হাসিকান্নায় মেখে মধুর রস তৈরি করতে…নবমীর নিশি তুমি পোহায়ো না।
চোখের জলে শুধু বিদায় হয় না, বিদায় হয় পান সন্দেশ দিয়ে মায়ের মুখ চুমিয়ে…থুতনিটি ধরে আদর করে যেন বলা, যাই বলতে নেই। বলো আসি।
ঘোরতর পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর প্রোডাকশন আমাদের উমা। সেই কবে কোনকালে গাঁজাখোর তরুণটির প্রেমে পড়ে তার গলায় মালাটি দিয়েছিলেন, তারপর থেকে একেবারে কৈলাসের ঘেরাটোপে বন্দি। সংসার নিয়ে নাকানিচোবানি। বছরে মাত্র চারটি দিন বাপের বাড়ি আসেন উমা, বড্ড কম দিন হল নাকি? তাই যেন আসতে না আসতেই যাওয়ার তাড়া। চোখের পলকে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ফুরোয়। নবমী এলেই যেন এসে গেল বিদায়ের পালা। দূরে গায়েনের দল গান ধরেছে…
মাকে যাত্যে দিব না কৈলাসে, ফিরে আয়…ক্ষ্যাপা শিব ক্যানে লিত্যে আলে…
কৃষিজমির দেশ আমাদের। সাধারণ কৃষক ঘরনি দুগ্গাকে করেছেন তাঁর ঘরের মেয়ে। বলছেন
এ বছর হবেক নাই ধান, পারি নাই ধান ফলাইতে
কর্তার আছে, উমারে পারিব রে খাওয়াওইতে। বরষার দিন গিয়া আইল কামরাঙা দিন…
বিদায়ের সময় এল, ঘরে ধান নেই, তা বলে কি মেয়েকে খাওয়াতে পারব না? আছে তো ধান কর্তামশাইয়ের গোলাতে। থাক মেয়ে ঘরে। মা খাওইয়াতে পারবে। থাকুক মেয়ে আর কয়েকটা দিন ঘরে। ফিরে যাক শিব।
বিদায়ের ক্ষণ যেন এত তাড়াতাড়ি না আসে। কিন্তু আশ্বিন মাসে শুক্লপক্ষের দশম দিনটি যে নড়চড় হওয়ার নয়! সে এসে পড়ে নবমীর রাত পোহাতে না পোহাতেই, চান্দ্র মাসের দশম দিনেই দুগ্গা ফিরবেন কৈলাসে। এর অন্যথা হওয়ার জো নেই। তাই দশমী শুরুতেই দর্পণ বিসর্জন। মায়ের প্রতীকী বিদায়। মায়ের পায়ের কাছে রাখা ছিল সে দর্পণখানি। তাতে মহামায়ার আত্মিক উপস্থিতি। দর্পণে দেবীর প্রতিবিম্ব দেখে তাকে জলে বিসর্জন দিয়ে শুরু হয় সিঁদুরখেলা, বিদায়ের আয়োজন।
দৈবীশক্তিসম্পন্ন দেবী, মাতা, কন্যা। তিন পরিচয়ে যে মৃন্ময়ীমূর্তি পূজিতা হন তা আকাশ, অগ্নি, বায়ু, জল ও মাটিতে মিশে যায় বিসর্জনের বিদায়ে। চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীরূপ দিয়েই বিদায় জানাতে হয়। চিন্ময়ীর তো বিদায় হয় না, তিনি নিত্যা, তিনি সদা সর্বভূতে বিরাজমান। তাই তাঁর মাটির রূপটিকে পঞ্চভূতে বিলীন করে বিদায়ের মালাখানি গলায় পরা। মানুষের দেহ যেমন পঞ্চভূতে গড়া, দেবীরও তাই। তিনি তো মানুষেরই দেবী। তাই মাটি থেকে তাঁর উদ্ভব, জলে তাঁর বিসর্জন। আবার তিনি নিরাকারা চিন্ময়ী হয়ে মানুষের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন।
এই ঐতিহ্য, এই রীতি। জলে যা বিসর্জন হয় তার ক্ষয় নেই। সামনের বছর আবার এসো মা। মমচানুগ্রহার্থায় পুনরাগমনায় চ। পুজোর শেষে শান্তিজল..বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি। কোথাও বা রেওয়াজমাফিক উড়িয়ে দেওয়া হয় নীলকণ্ঠ পাখি। অতি ভক্তিমান বা ভক্তিমতী হয়তো দেখতেও পান, মায়ের মুখে গর্জনতেলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অশ্রুরাশি। নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গেল, কৈলাসে মহাদেবকে খবর দিতে, এবার উমা কৈলাসে ফিরছেন। কিন্তু শিব তো এই ক’দিন উমার মাথার ওপরেই ছিলেন। তিনি কি তবে আগেই ফিরেছেন? তাই হয়তো হবে। বিজয়ায় জামাই বিদায়ের ঘটাপটা নেই, এ শুধু মেয়ে বিদায়ের অশ্রুসিক্ত মুহূর্তগুলি। এখানে অশ্রুতে যন্ত্রণার চেয়ে আনন্দ অধিক, নতুন কাজ শুরু করার শুভ মুহূর্ত বিজয়া দশমী। বিদায়কে উৎসব করে তোলার শিল্প আর সাংস্কৃতিক বোধ বাঙালির মজ্জাগত। কল্পনা আর সৃজনশীলতার একটি পরিপূর্ণরূপ মহামায়া, তাঁর বিদায় অবাঙালি মতে ‘বিদাই’ বা ‘ভিদাই’ নয়। তাঁর নিমজ্জনে গভীর আধ্যাত্মিকতাবোধ, যার তাৎপর্য প্রাণীজগতের শুভাশুভের দ্বন্দ্বের সঙ্গে মিশে আছে।
‘যৎ পূজিতং ময়া দেবী পরিপূর্ণং তদস্তু মে’
হে দেবী, আমার পূজা যেন পূর্ণতা পায়।
শূন্য মণ্ডপ, ভাঙা হাট…সব আনন্দ যেন নিয়ে চলে গেলেন জননী। বিদায়ের ক্ষণটুকু যাতে বিষাদমলিন না হয় সেজন্য বিদায়ের উৎসব বাঙালির বিজয়া দশমী।
মূর্তি বিসর্জনের আগে সপুত্রকন্যা মায়ের মুখে দেওয়া হয়েছে বাঙালির প্রিয় মিষ্টি, সন্দেশ। বিদায়ের লগ্নে কোলাকুলি আর প্রণামের পালা শেষে মিষ্টিমুখের ঐতিহ্য। মা কেন গিয়েছেন? আবার সামনের বছর আনন্দের পসরা নিয়ে আসবেন বলে!
দেবী কি একেবারে চলে যেতে পারেন কখনও? মা ফেলে যেতে পারেন সন্তানকে? ঢাকের বাদ্যি থেকে কাঁসরঘণ্টা বলে, ‘আবার এসো।’ বাড়ির বড় গিন্নি লাল গরদে ঘোমটা দিয়ে বলেন, ‘আবার এসো।’ জিনস পরা বালিকা চোখের মাস্কারা মুছে বলে, ‘আবার এসো মা।’ সেজোকর্তা ধুতি সামলাতে সামলাতে বলেন…‘আসছে বছর!’ ঐশ্বরিক মহিমা কখন যে একান্ত মানবিক হয়ে মায়ের আঁচলের খুঁটে, খোকার আধোবুলিতে, খুকির উজ্জ্বল চোখের মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছে, কে জানে!
তাই বাঙালির বিজয়া দশমীর বিদায় মানে…এই, সামনের বছর পুজো কবে রে?
দশমীর বিদায়ের দিন দশেরা উৎসব। রামচন্দ্রের রাবণ নিধন, অশুভ শক্তিকে হারিয়ে শুভ শক্তির জয়। ওই শুক্লাদশমীতেই অজ্ঞাতবাস পর্বে শমিবৃক্ষ থেকে অস্ত্র নামিয়ে কৌরবদের যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। কিন্তু বাঙালি হিন্দুর বিজয়া দশমীর বিদায়ে কোনও সংহার নেই। এ কেবল দেবী বিদায়ের ব্যথা, কিংবা তার অধিক কন্যা বিদায়ের বেদনা। এক চিরকালীন ঘরোয়া বিষণ্ণতা, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে আশার আলো…আসছে বছর আবার হবে। তাই তো বিদায়ের সময় মায়ের মুখে মিষ্টান্ন দিয়ে ছলছল চোখে বলে ওঠা, যাই বলে না মা। বলো আসি। দুগ্গা, দুগ্গা।
জলে ভাসে মায়ের পানপাতাসদৃশ মুখ, রাংতার মুকুটখানি-
যেন দর্পণে শরৎশশী। আকাশ, বাতাস, বৃক্ষ বলে… আবার এসো। নদীর জল বলে, আবার এসো। যা কিছু নদীগর্ভে লীন হয়, তারই তো পুনর্জন্ম হয়!
মানুষ আর মহাকাশের স্বর যেন মিলে মিশে যায়। কলস্বরে বলে ওঠে বিদায়ের বাণী…আবার এসো মা! তিনি আদ্যাশক্তি, তিনি মহামায়া…তাঁকে বিদায় দেবে কে?