মোহন্তের কামনার ফাঁদে তারকেশ্বরের ষোড়শী গৃহবধূ! উত্তাল হয়েছিল দেড়শো বছর আগের বাংলা

মোহন্তের কামনার ফাঁদে তারকেশ্বরের ষোড়শী গৃহবধূ! উত্তাল হয়েছিল দেড়শো বছর আগের বাংলা

স্বাস্থ্য/HEALTH
Spread the love


বিশ্বদীপ দে: একটি খুন। তার সঙ্গে জড়িয়ে পরকীয়া। আজকের দিনে সংবাদমাধ্যমে উঁকি দিলে এমন খবরে চোখ পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এমন ঘটনা যেন প্রায় নিয়মিতই হয়ে পড়েছে। কিন্তু একে কেবল আধুনিক সময়ের অপরাধ বলে দেগে দিলে হবে না। আজ থেকে দেড়শো বছরেরও বেশি আগে গোটা বাংলা তুলকালাম হয়ে গিয়েছিল এমনই এক ঘটনায়। লোকের মুখে মুখে ফিরেছিল এলোকেশী, মোহন্ত আর নবীনচন্দ্রের কথা। তখন কোথায় সোশাল মিডিয়া, কোথায় টিভি! তবুও দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল সেই খবর। কালীঘাটের পট থেকে পাঁচালি গান কিংবা প্রহসনের জন্ম হয়েছিল। এত বছর পরও তাই থেকে গিয়েছে সেদিনের উত্তেজনার জলছাপ।

তারকেশ্বরের কাছেই কুমরুল গ্রাম। সেখানেই থাকতেন নীলকমল মুখোপাধ্যায়। দরিদ্র ব্রাহ্মণ। স্ত্রী মন্দাকিনী এবং আগের পক্ষের দুই কন্যা এলোকেশী ও মুক্তকেশীকে নিয়ে তাঁর সংসার। এলোকেশীর বিয়ে হয়েছিল সরকারি কর্মচারী যুবক নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখেছিলেন এলোকেশী। মোটের উপর সুখের সংসার। কিন্তু সেই সুখের উপরেই কালো ছায়া পড়ল একদিন! সেই ছায়ার নাম তারকেশ্বরের মোহন্ত মাধবচন্দ্র গিরি। মন্দিরের সর্বেসর্বা হওয়ার কারণে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল দেখার মতো। এহেন মাধবের নজর পড়ল ষোড়শী গৃহবধূ এলোকেশীর উপরে। আর তাঁকে কাছে পেতে সে ছড়াল টাকার ফাঁদ। এলোকেশীর সৎ মা (তিনি মোহন্তের পূর্ব পরিচিতা) তো বটেই, তার বাবারও চোখ ধাঁধিয়ে গেল সেই ফাঁদে পা দিয়ে। এরপর নিঃসন্তান কন্যাকে সন্তানলাভের কথা বলে পাঠানো হল মোহন্তের কাছে। সে নাকি ‘অলৌকিক ওষুধ’ দেবে। এদিকে নবীনচন্দ্র চাকরির কারণে থাকতেন দূরে। তিনি এসবের কিছুই জানতে পারলেন না। আর সেই সুযোগে এলোকেশীকে মাদক খাইয়ে বেহুঁশ করে তাঁকে ধর্ষণ করে সে। এবং সেই শুরু। জানা যায়, লাগাতার নাকি ফাঁদে ফেলে এলোকেশীকে ডেকে পাঠিয়ে যৌন নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছিল মোহন্ত।

চাপা থাকল না এই অনাচার। ধীরে ধীরে এলাকার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল খবর। নবীনের কানেও পৌঁছল তা। তিনি কার্যতই বিশ্বাস করতে পারলেন না ব্যাপারটা। কিন্তু এলোকেশী গোপন রাখেননি কিছু। স্বামীকে জানিয়ে দিলেন, কীভাবে মা-বাবার নির্দেশে এই কাজ করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে ‘অলৌকিক ওষুধ’ ও সন্তানলাভের টোটকা প্রসঙ্গও এড়ালেন না। অসহায় নবীন এরপরই মনস্থ করেন আর এখানে নয়। ‘কলঙ্কিনী’ স্ত্রীকে নিয়ে অন্যত্র পাড়ি দেওয়াই মনস্থ করলেন তিনি। কিন্তু চাইলেই তো হবে না। ‘প্রভাবশালী’ মোহন্ত রয়েছে যে। সে এমনই ভয়ংকর লোক, জায়গায় জায়গায় পাহারা বসাল সে। এত লোকের চোখে ফাঁকি দিয়ে এই জায়গা যে ত্যাগ করা সম্ভব নয়, বুঝে গেলেন নবীন। তাহলে এবার?

ক্রমশ সামনের সব পথ কুয়াশায় ঢেকে গেল নবীনের সামনে। ক্ষোভে-দুঃখে-অসহায়তায় এবার তিনি আঁশবঁটি বসিয়ে দিলেন স্ত্রীর গলায়। মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল এলোকেশীর দেহ। পাশেই গড়াগড়ি খাচ্ছে কাটা মাথা। বইছে রক্তস্রোত। ১৮৭৩-এর ২৭ মে এলোকেশীর মৃত্যুর পর সেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল গোটা বাংলায়। ঘটনার পর পুলিশের কাছে নিজেই ধরা দেন নবীন। অন্যদিকে গ্রেপ্তার করা হল মোহন্তকেও। শুরু হল বিচার। ১২৮০ বঙ্গাব্দের ২৯ জ্যৈষ্ঠ ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায় ‘একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল এলোকেশীর মৃত্যুর খবর। যা মুহূর্তে বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

হুগলি সেশন জজ কোর্টে জুরিরা মত দিলেন, নবীন খুন করলেও নিজের মধ্যে ছিলেন না তিনি। কিন্তু বিচারক এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। তিনি মামলা পাঠালেন হাই কোর্টে। সেখানে নবীনকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানোর রায় দেওয়া হল। আর মোহন্ত? তার জেল হল তিনবছরের। সেই সঙ্গে দুহাজার টাকা জরিমানা।

খুনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বিচার প্রক্রিয়া চলার সময়ও গোটা বাংলা জুড়ে চর্চার শেষ ছিল না তারেকশ্বর হত্যা মামলা নিয়ে। রায় বেরনোর আগেই বটতলায় একের পর প্রহসন প্রকাশিত হতে শুরু করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বোধহয় লক্ষ্মীনারায়ণ দাসের ‘মোহন্তের এই কি কাজ!!’ এছাড়াও ‘উঃ! মোহন্তের এই কাজ!!’. ‘মোহন্তের যেমন কর্ম তেমনি ফল’ বা ‘তারকেশ্বর নাটক’-এর কথাও বলা যায়। আজ এই সব প্রহসনের ‘টেক্সট’ নিতান্তই দুর্লভ। কিন্তু নামকরণ থেকেই পরিষ্কার, নিরীহ গৃহবধূকে ধর্ষণের পর বাংলাজুড়ে মোহন্তের বিরুদ্ধে কীভাবে জনরোষ তৈরি হয়েছিল!

যদিও নবীন কার্যতই সকলের সহানুভূতিই পেয়েছিলেন। স্ত্রীকে খুন করার পরও তাঁর প্রতি জনতার মমত্ব বর্ষিত হয়েছিল। লেখা হয়েছিল জনপ্রিয় পাঁচালি গানও- ‘মোহন্তরে লয়ে কত নিউশ ছাপিল।/ মোহন্ত লইয়া কত থিয়েটার হলো।।/ মোহন্ত লইয়া কত বৈষ্ণবাদিগণ।/ সঙ্গীত গাইয়া অর্থ করে উপার্জন…।।’ এখানেই শেষ নয়। কালীঘাটের পটেও এলোকেশী। কোনও ছবিতে এলোকেশীকে বলপূর্বক মদ খাওয়ানোর দৃশ্য। কোথাও বা জেলে সাজাভোগ করা মোহন্ত। এরই পাশাপাশি এলোকেশী বঁটি, এলোকেশী শাড়ি পর্যন্ত বাজারে ছেয়ে গেল! ভাবা যায়! একটি সংবাদকে কেন্দ্র করে এমন বিপণনের বাজার। আজকের প্রচারসর্বস্বতার দিনেও তা বোধহয় সম্ভব নয়।

যাই হোক, শেষপর্যন্ত নবীনকে কিন্তু যাবজ্জীবন সাজাভোগ করতে হয়নি। তাঁকে ক্ষমা করার আর্জি জানিয়ে প্রশাসনের কাছে জমা পড়েছিল চিঠি। তাতেই স্বাক্ষর পড়েছিল দশহাজার। এর জেরে শেষমেশ দুবছর পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল নবীনকে। বাকি জীবন সে কেমন কাটিয়েছিল, তা সেভাবে জানা যায় না। জনমানসে তা জানার আগ্রহও ছিল না। বরং এলোকেশী ও তাঁর দাম্পত্য, আর সেই দাম্পত্যে মোহন্তের ষড়যন্ত্রের কাহিনিটুকুই থেকে গেল।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *